নড়াইল মুক্ত দিবস শুনড়াইল মুক্ত দিবস আজক্রবার (১০ ডিসেম্বর) । ১৯৭১ সালের এই দিনে নড়াইলের মুক্তিপাগল দামাল ছেলেরা বুকের তাজা রক্তদিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সম্মুখ যুদ্ধে পরাজিত করে তাদের হাত থেকে নড়াইলকে মুক্ত করে। এ উপলক্ষে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ইউনিট, জেলা শিল্পকলা একাডেমি, চিত্রা থিয়েটারসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে কর্মসূচি পালিত হবে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে রুপগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড বদ্ধভূমি, জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন, পুরাতন বাসটার্মিনাল এলাকার বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল, জেলা প্রশাসকের কার্যালয় বঙ্গবন্ধ্যু ম্যুরাল, জেলা জজ আদালত সংলগ্ন বদ্ধভূমি ও জেলা শিল্পকলা একাডেমি চত্বরে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে পুস্পমাল্য অর্পন। রুপগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড বদ্ধভূমিতে পুষ্পমাল্য অর্পন শেষে র্যালি করে পর্যায়ক্রমে পুস্পমাল্য অর্পন করে জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে আলোচনাসভা। রুপগঞ্জ বাজারে এনভায়রনমেন্টাল থিয়েটার ও গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী জারিগান অনুষ্ঠিত হবে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কথা বলে জানাযায়, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে দশ লক্ষাধিক মানুষের বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষনে স্বাধীনতার যে আহ্বান ছিল নড়াইলের মুক্তিপাগল জনতা তা থেকে পিছপা হয়নি। ওই সময় নড়াইলের এসডিও’র বাসভবনকে স্থানীয় মুক্তিযুদ্ধের হাই কমান্ডের সদর দপ্তর করা হয়। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে তৎকালীন নড়াইলের এসডিও কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, এমএনএ খন্দকার আব্দুল হাফিজ, এমপিএ শহীদ আলী খান, আওয়ামীলীগ নেতা এখলাছ উদ্দিন, বিএম মতিয়ার রহমান লোহাগড়া হাই স্কুলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও নড়াইলের সংগঠিত মুক্তিযোদ্ধাদের এক করে বিশাল বাহিনী যশোর অভিমুখে পাঠিয়ে দেন। ৬ এপ্রিল সকালে পাক হানাদার বাহিনী দুটি জেট বিমান হতে নড়াইল শহরের ওপর ব্যাপক ভাবে মেশিনগানের গুলি ও বোমা নিক্ষেপ করে প্রচুর ক্ষতি সাধন করলে নড়াইল শহর জনশুন্য হয়ে পড়ে। ১৩ এপ্রিল হানাদার বাহিনীর একটি দল নড়াইল শহরের চৌরাস্তায় রেস্টুরেন্ট মালিক মন্টুকে গুলি করে আহত করে এবং হরিপদ সরদার, ভাটিয়া গ্রামের কালু বোস, সরসপুর গ্রামের প্রফুল্য মিত্রকে ধরে নিয়ে দাইতলা পুলের নিকট গুলি করে ফেলে রেখে চলে যায়। এদিকে ক্যাপ্টেন দোহার উদ্যোগে লোহাগড়ার ইতনা ও আড়িযারায় প্রশিক্ষন শিবির খোলার কারনে মধুমতি-নবগঙ্গা নদীর তীরবর্তী অঞ্চলের ভাটিয়াপাড়াস্থ হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প হতে তাদের দোসর দের সহযোগিতায় গানবোট যোগে ইতনা গ্রামে নৃশংস অভিযান চালিয়ে ওই গ্রামের ৫৮ জন নারী-পুরুষ-শিশুকে হত্যাকরে। ওই সময় নড়াইলের জামায়াতনেতা মওলানা সোলায়মানের নেতৃত্বে “শান্তিবাহিনী গঠিত হয়”। এ বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে দেশপ্রেমিক শত শত মানুষকে ধরে এনে নড়াইল ডাকবাংলোয় আটক রাখা হত। এসব ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কাল্পনিক অভিযোগ এনে মাওণালা সোলায়মান রেজিষ্টারে যাদের নামের পাশে লালকালি দিয়ে “রিলিজ ফর ইভার” লিখে দিত তাদের ইসকর্টপ পার্টি ও জল্লাদরা গভীর রাতে নড়াইল শহরের লঞ্চঘাটের পাটুনের ওপর নিয়ে জবাই করে হত্যাকরে নদীতে ফেলে দিত । এভাবে মাওলানা সোলাইমান চেনা অচেনা সহস্রাধীক মানুষকে জবাই করে হত্যা করে বলে একাধীক সূত্রে জানা যায়। এছাড়া ব্যাক্তিগত আক্রসে মাওলানা সোলায়মান নিজগ্রাম তুলারামপুরের আওয়ামীলীগের সদস্য নড়াইল ভিসি স্কুলের মাষ্টার আতিয়ার রহমান তরফদার, আঃসালাম তরফদার, রফিউদ্দিন তরফদার, মাহতাব তরফদার, মোকাম মোল্যা, কাইজার মোল্যা, মকবুল হোসেন সিকদার, ও চাচড়া গ্রামের ফয়জুর রহমানসহ অনেককে ধরে এনে শহরের পানি উন্নয়ন বোর্ড এলাকায় নিয়ে নিজেদের দিয়ে কবর খুড়ে তাদের হত্যা করে গর্তের মধ্যে পুতেরাখে। এছাড়া নকসালরা পেড়লী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আঃহামিদ মোল্যা, আবুয়াল হোসেন, নায়েব নজির হোসেনসহ অনেককে হত্যা করে। এভাবে শত কষ্টের মাঝেও দেশ হানাদার মুক্ত করার এক দূর্জয় আকাংখা নিয়ে মুক্তি বাহিনীর কমান্ডার হিসাবে সদর থানায় উজির আলী, লোহাগড়া থানায় মোক্তার আলী, ও কালিয়া থানায় ওমর আলীকে এবং মুজিব বাহিনীর কমান্ডার হিসাবে সদর থানায় শরীফ হুমায়ুন কবীর, লোহাগড়া থানায় শরীফ খসরুজ্জামান, ও কালিয়া থানায় আব্দু মজিদ সরদারকে নিযুক্ত করে নড়াইলে প্রবেশ করে। অক্টোবার মাস হতে জেলার প্রত্যান্ত অঞ্চলের মুক্তিপাগল মানুষের মনে এক বিশ্বাস জন্মাতে থাকে যে হানাদার বাহিনী বা তাদের দোসররা আর বেশীদিন টিকতে পারবেনা। ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকেই নবগঙ্গা নদীর উত্তর ও পূর্বাঞ্চাল হানাদার মুক্ত হয়ে যায়। লোহাগড়া থানা পাক হানাদার বাহিনীর ঘাটিকে ৭ ডিসেম্বরের মধ্যে মুক্তি বাহিনীর কমান্ডার গন আতœসমর্পনের নির্দেশ দিলে তারা আতœসমর্পন না করায় ৮ ডিসেম্বর শরীফ খসরুজ্জামান, দবির উদ্দিন, ইউনুস আহমেদ, লুৎফর মাষ্টার, আলী মিয়া, লুৎফর বিশ্বাসসহ অনেক গ্রুপ এত্রিত হয়ে সম্মিলিত ভাবে তিন দিক থেকে লোহাগড়া থানা আক্রমন করলে প্রচন্ড যুদ্ধের পর হানাদার বাহিনী আতœসমর্পন করে। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা নড়াইলে হানাদার বাহিনীর ঘাটির দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ৮ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী এস এম ফজলুর রহমান জিন্নাহ’র নেতৃত্বে নড়াইল কলেজের দক্ষিনে মাছিমদিয়া গ্রামে সমবেত হয়ে পুলিশ-রাজাকারদের উপর অতর্কিত হামলা চালালে এই যুদ্ধে তরুন মুক্তিযোদ্ধা জয়পুরের মিজানুর রহমান হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হন। মিজানুর রহমানের মৃতদেহ হানাদার বাহিনীর দোসররা হাত-পা বেঁধে বাশে ঝুলিয়ে নড়াইল শহর প্রদক্ষিন করে কৃতিত্ব দেখায় এবং ছবি তোলে। এ ঘটনার পর ৯ ডিসেম্বর রাতে বিজয়ের তীব্র আকাংখা নিয়ে কমান্ডার ফজলুর রহমান জিন্নাহ, আমির হোসেন, উজির আলী, শরীফ হুমায়ুন কবীর, আঃ হাই বিশ্বাসের নেতৃত্বে বর্তমান নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের দক্ষিন দিক থেকে আক্রমন চালালে পাল্টা আক্রমনে বাগডাঙ্গা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মতিয়ার রহমান শহীদ হন। শহরের পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাংলোতে অবস্থানরত ৪০ জন পাক মিলিটারিকে আতœসমর্পনের নির্দেশ দিলে তারা আত্মসমর্পনে অস্বীকার করেন। এসময় মুক্তি বাহিনীর সদস্যরা চতুদিক থেকে প্রচন্ড গোলাবর্ষন শুরুকরলে পাক মিলিটারিরা আতœসমর্পন করতে বাধ্য হয়। এখানে কয়েকজন পাক মিলিটারি নিহত হয় এবং অন্যদের জেল হাজতে পাঠানো হয়। শীতের রাতে প্রবল শীতকে উপেক্ষা করে মুক্তিযোদ্ধারা সারা রাত শহরে বিজয় উল্লাস করতে থাকে ও জয় বাংলা শ্লোগানে শহর প্রকম্পিত করে তোলে এবং ১০ ডিসেম্বর সকালের দিকে নড়াইলকে পাক হানাদার মুক্ত ঘোষনা করা হয়। পরে মুক্তি পাগল হাজারো জনতার উপস্থি’তিতে ডাকবাংলো প্রঙ্গনে আনুষ্টানিক ভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তলন করেন। মুক্তিযুদ্ধে নড়াইলে ৫ জন খেতাব প্রাপ্ত হন তারা হলেন ল্যান্স নায়েক বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ, বীর উত্তম মুজিবুর রহমান, বীর বিক্রম আফজাল হোসেন, বীর প্রতীক খোরশেদ আলম ও বীর প্রতীক মতিয়ার রহমান।