পূর্বসূরিদের ধারাবাহিকতায় আমারও হাতেখড়ি লালপুরের নাবিরপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, ধুলো ভরা গ্রাম্যরাস্তা, দুপাশে ঘন ঝোঁপঝাড় আর দৈত্যকার পুরোনো আমগাছ। বসতি এমনতিই কম, তার উপর মধ্যরাস্তায় এক বিশাল শ্যাওড়া গাছ। কৃঞ্চপক্ষে সে গাছের আশেপাশে নাকি বিশাল আকৃতির মানব সদৃশ প্রানীর দেখা পেয়েছেন অনেকেই। এমন ভাবতে দুরুদুরু বুকে বারবার ফুঁদিয়ে স্কুলের দিকে পা বাড়াতাম একাই। তবে বর্ষাকালে ভিন্নরুপে, সে সময় বর্ষায় বান ঠেকাতে মেঠো রাস্তা কেটে দুপাশের পানির সমতা রক্ষা করা হতো। এরকম ৪ টা জায়গায় কাটা রাস্তায় বানের পানি পেরিয়ে স্কুল যেতে হতো। বর্ষায় পানির উচ্চতা যত বাড়তো পরনের প্যান্টও ততটা উপরে উঠতো,, কোনও কোনও দিন তো একবারে হ্যান্ডস আপ করে একহাতে বই, আর জামা-প্যান্ট অন্য হাতে নিয়ে বুক সমান পানি পারাপার…
১ থেকে ১০ পর্যন্ত গণনা শেখার জন্য সবাইকে স্কুল সংলগ্ন পুকুর পাড়ে বিশাল তেতুঁল গাছের ছায়ায় একলাইনে দাঁড় করানো হতো। প্রথমে মাষ্টার মশাই সুর করে বলতেন, ১ এ চন্দ্র, ২ এ পক্ষ…
তারপর আমরা সবাই সমবেত কন্ঠে বলতাম,
১ এ চন্দ্র, ২ এ পক্ষ, ৩ এ নেত্র, ৪ এ বেদ, ৫ এ পঞ্চবান, ৬ এ ঋতু, ৭ এ সমুদ্র, ৮ এ অষ্টবসু, ৯ এ নবগ্রহ, ১০ এ দিক…
এভাবেই গণনা শেখা। শ্যাওড়া গাছের ডাল দিয়ে বানানো চিকন বেত হাতে পাঁয়চারি করতে করতে স্যার বলতেন, সবাই শোন, লেখাপড়া শেখা কিন্তু অনেক কঠিন কাজ…
সেদিন ১ এ চন্দ্র ছাড়া আর কোনটারই মানে জানতাম না, এতদিন পরে তা জানলাম…
১-এ চন্দ্র= চাঁদ
২-এ পক্ষ = কৃষ্ণ ও শুক্ল
৩-এ নেত্র= ডান চক্ষু, বাম চক্ষু ও জ্ঞান চক্ষু ৪-এ বেদ= ঋক, সাম, যজু ও অথর্ব
৫-এ পঞ্চবান=মন্মোহন, উদ্মাদন, শোষণ,তাপন
ও স্তম্ভন
৬-এ ঋতু=গ্রীষ্ম,বর্ষা,শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত
৭-এ সমুদ্র=লবন, ইক্ষুরস, সুরা, ঘৃত,দধি,ক্ষীর
ও স্বদুদক
৮-এ অষ্টবসু= অনল, অনিল, সোম, অহম, ধরা,
ধ্রুব, প্রত্যুষ ও প্রভব
কিংবা মনস্মৃতিমতে .
সোম,অগ্নি,অর্ক, অনিল, ইন্দ্র,
কুবের, বরুণ ও যম।
৯-এ নবগ্রহ= সূর্য্য, চন্দ্র,মঙ্গল,বুধ,বৃহস্পতি,
শুক্র, শনি, রাহু ও কেতু।
১০-এ দিক=পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ,ঈষাণ
অগ্নি, বায়ু, নৈঋত, উর্দ্ধ ও অধঃ
আজ ১ থেকে ১০ পর্যন্ত গণনা শেখানোর তরিকা আর শবাদগুলো দেখে বুঝলাম, মাষ্টারমশাই কেন বলতেন, লেখাপড়া শেখা অনেক কঠিন কাজ…!!!
লেখকঃ বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির আইন প্রশিক্ষক হাসান হাফিজুর রহমান।