আমার ধর্মকর্মে বেশ উদাসীন মা, যাঁর জীবনে মুখ্যত দুটি আনন্দ- গান আর মানুষজন, দিদিমার পেড়াপীড়িতে মাত্র তিনটি ষষ্ঠী করতেন – সরস্বতী পুজোর পরের দিন শীতল ষষ্ঠী, দুর্গাষষ্ঠী আর চৈত্রে বছর শেষের নীলষষ্ঠী।
সারাদিন উপোস থেকে (অর্থাৎ অতি উপাদেয় সাবু মাখা খেয়ে) সন্ধেয় নীলকণ্ঠ শিবের মাথায় ডাবের জল ঢেলে উপোসভঙ্গ (বেশি কিছু না, ঘিয়েভাজা পাটে পাটে খুলে যাওয়া চারটি পরোটা, শুখনো শুখনো আলুর দম, বেগুন ভাজা, আর মিস্টি তো শেষ পাতে মাস্ট)। তো এই সব ব্রতীদের জন্যেই রাসমাঠে অস্থায়ী চালাঘর বানানো হয়েছে, যাকে বলা হচ্ছে নীলের ঘর, সেখানে আজকের দিনে অধিষ্ঠান করছেন নীলকণ্ঠ শিব। চালাঘরটি বেজায় নিচু, প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হয়, তারপর সেখানে ঠেলাঠেলি, তার মধ্যে মা কোনরকমে ঢুকছেন, আমি খুব সিরিয়াস মুখ করে ডালা নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘামছি, ডালায় সশিস ডাব, পাঁচ রকম ফল, তার মধ্যে মুখ্য ভূমিকায় বেল, আরো কত কী এবং অবিশ্যি অবিশ্যি কাঁচা দুধ।
এই কাঁচা দুধ নিয়ে ঝক্কি কম না। প্রায় প্রতি বছরেই কাঁচা দুধ রাখার কথা মা ভুলে যেতেন, তখন মার বিপত্তারিণী হয়ে দেখা দিতেন দুধের দিদি, মানে যে মুসলমান মহিলা আমাদের দুধ দিতেন। তিনি আমার মায়ের বেস্ট ফ্রেন্ড। দুধ দিতে এসে মিনিমাম এক ঘণ্টা গল্প হত দুজনের। মা ভুলে যাবেন জেনেই তিনি প্রতিবার খানিকটা কাঁচা দুধ সরিয়ে রেখে দিতেন। তাঁর স্বামীর নাম সম্ভবত ছিল আকবর, কিন্তু দিদির নামটি যে কী হাজার জিগেস করেও জানতে পারিনি। স্বামীর বাড়িতে থাকতেন, কিন্তু ঘরে নয়, ঘরণী ছিল আরেকজন। নিজের ও তিন ছেলেমেয়ের ভাত নিজেকেই যোগাড় করতে হত আর সেটা ওই দুধ বিক্রি করেই। মুসলমানের পোষা গরু মুসলমান হয় কিনা আমি জানি না, মহাদেবও জানেন না। সেই গরুর দুধ মাথায় ঢালায় শিবের কোনদিন তো আপত্তি দেখিনি!!
এই দিদির বাড়িতে প্রতিবার ঈদের নেমন্তন্ন থাকত আমার। ছোট্ট একটা ঘর, টালির চাল, কি পরিপাটি করে সাজানো। নতুন জামায় সাজা দিদির ছেলে মেয়েরা আমাকে কোথায় বসাবে ভেবে পায় না।ঝকঝকে চিনেমাটির প্লেটে ভাজা সেমাই, দুধে সেদ্ধ সেমাই, মিস্টি আসে। দিদি এমনিতেই সারা বছর কঠোর পরিশ্রম করে সংসার চালান। রোজ দুপুরে দেখি তিনি মলিন শাড়ি পরে গরু চরিয়ে ফিরছেন। সেই দিদির পরনেও আজ নতুন শাড়ি। গোটা রমজান মাস ধরে ভোর থেকে সন্ধে নির্জলা উপবাসের পর খুশির ঈদের ছটা তাঁদের মুখে চোখে।
আমার কাছে রোজা মানে সেই আত্মমর্যাদাপূর্ণ সেই নারীর একক লড়াই, যিনি অন্য ধর্মের এক ব্রতীর ব্রত উদযাপনে কাঁচা দুধ রাখতে ভোলেন নি কোনদিন। আমার কাছে রোজা মানে আমার মায়ের মনে করে দিদির জন্যে শাড়ি কিনে পাঠানো। আজ চারদিকে সাম্প্রদায়িক বিষের মধ্যে বসে তাঁদের খুব মনে পড়ে।
লেখক সম্পর্কে
তৃষ্ণা বসাক এই সময়ের বাংলা সাহিত্যের একজন একনিষ্ঠ কবি ও কথাকার। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, কল্পবিজ্ঞান, মৈথিলী অনুবাদকর্মে তিনি প্রতিমুহুর্তে পাঠকের সামনে খুলে দিচ্ছেন অনাস্বাদিত জগৎ। জন্ম কলকাতায়। শৈশবে নাটক দিয়ে লেখালেখির শুরু, প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘সামগন্ধ রক্তের ভিতরে’, দেশ, ১৯৯২। প্রথম প্রকাশিত গল্প ‘আবার অমল’ রবিবাসরীয় আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৯৯৫।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.ই. ও এম.টেক তৃষ্ণা পূর্ণসময়ের সাহিত্যকর্মের টানে ছেড়েছেন লোভনীয় অর্থকরী বহু পেশা। সরকারি মুদ্রণ সংস্থায় প্রশাসনিক পদ, উপদেষ্টা বৃত্তি,বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিদর্শী অধ্যাপনা, সাহিত্য অকাদেমিতে আঞ্চলিক ভাষায় অভিধান প্রকল্পের দায়িত্বভার- প্রভৃতি বিচিত্র অভিজ্ঞতা তাঁর লেখনীকে এক বিশেষ স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে।
প্রাপ্ত পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে- পূর্ণেন্দু ভৌমিক স্মৃতি পুরস্কার ২০১২, সম্বিত সাহিত্য পুরস্কার ২০১৩, কবি অমিতেশ মাইতি স্মৃতি সাহিত্য সম্মান ২০১৩, ইলা চন্দ স্মৃতি পুরস্কার (বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ) ২০১৩, ডলি মিদ্যা স্মৃতি পুরস্কার ২০১৫, সোমেন চন্দ স্মারক সম্মান (পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি) ২০১৮, সাহিত্য কৃতি সম্মান (কারিগর) ২০১৯, কবি মৃত্যুঞ্জয় সেন স্মারক সম্মান ২০২০, নমিতা চট্টোপাধ্যায় সাহিত্য সম্মান, ২০২০ ও অন্যান্য আরো পুরস্কার।
বর্তমানে কলকাতা ট্রান্সলেটরস ফোরামের সচিব।