নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের মাধ্যমে উন্নয়ন প্রকল্পে বিদেশিদের উপর নির্ভরশীলতার ‘অচলায়ন’ ভাঙতে পারার কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের তিন দিন আগে বুধবার সকালে নিজের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “সাহস নিয়ে নিজেদের টাকায় নিজেরা পদ্মা সেতু করার ফলে আজকে বাংলাদেশের সম্মানটা ফিরে এসেছে। নইলে আমাদের দেশের সকলের একটা পারসেপশন ছিল, একটা মানসিকতা ছিল যে, আমরা অন্যের অর্থায়ন ছাড়া কিছুই করতে পারব না।
“এই যে একটা পরনির্ভরশীলতা, পরমুখাপেক্ষিতা এটাই কিন্তু আমাদের মাঝে ছিল। একটা দৈন্যতা ছিল। বিশ্ব ব্যাংক যখন এই টাকাটা তুলে নিয়ে গেল আমরা যখন সিদ্ধান্ত নিলাম, অন্তত আমরা সেই জায়গার থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছি। সেই অচলায়ন ভেঙে আমরা যে একটা আত্মমর্যাদাশীল জাতি, আমরা যে পারি, সেটা প্রমাণ করতে পেরেছি।”
আগামী শনিবার উদ্বোধন হতে যাওয়া পদ্মা সেতুর কাজ এক দশক আগে শুরুর সময় এই প্রকল্পে যুক্ত ছিল বিশ্ব ব্যাংকসহ বিভিন্ন ঋণদাতা সংস্থা।
তখন দুর্নীতির অভিযোগ তুলে প্রকল্প থেকে সরে গিয়েছিল বিশ্ব ব্যাংক। টানাপড়েনের এক পর্যায়ে তাদের বাদ দিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন শেখ হাসিনা।
সেই কাজ শেষ করে এ মাসেই ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ ওই সেতুতে গাড়ি উঠতে যাচ্ছে, রাজধানীর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চল।
সেই সময় বিশ্ব ব্যাংকের সরে যাওয়ার পেছনে গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ‘প্ররোচনা’ থাকার কথা বলে আসছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সেতু যখন উদ্বোধনের দ্বারপ্রান্তে, তখন বুধবারের সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিক জানতে চান- বিশ্ব ব্যাংকের পক্ষ থেকে অর্থায়ন নিয়ে কোনো দুঃখপ্রকাশ করা হয়েছে কি-না বা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি-না?
উত্তরে শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্ব ব্যাংকের বিষয়ে বলব… ওই যে একটা কথা আছে না, ‘নিজের ভাঁড় ভালো না, গোয়ালার ঘিয়ে দোষটা কী!’ তারা বন্ধ করল কাদের প্ররোচনায়, আমাদের দেশেরই লোকের প্ররোচনায় তারা বন্ধ করেছিল, এটাইত বাস্তবতা।
“আমার তো কিছু বলার দরকার নাই। তারা নিজেরাইতো বুঝতে পারবে। যদি তাদের অনুশোচনা থাকে। আর না থাকলে কিছু আমার বলার নাই কারও বিরুদ্ধে।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, উন্নয়ন সহযোগী হিসাবে বিশ্ব ব্যাংক থেকে যে আর্থিক সহায়তা আসে, সেটা তারা ’অনুদান বা ভিক্ষা দেয় না’। বরং, ঋণ হিসাবে নিয়ে সেগুলো পরিশোধ করা হয়।
“বিশ্ব ব্যাংকের আমরা কিন্তু অংশীদার। তারা কিন্তু কোনো অনুদান দেয় না। আমরা লোন নিই, এটি কিন্তু সকলের মাথায় রাখতে হবে। আমরা কিন্তু সেখান থেকে লোন নিই, টাকা নিই।”
পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে সরে গেলেও বাংলাদেশের জন্য বরাদ্দ হওয়া ওই অর্থ অন্যান্য প্রকল্পে আসার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “যে টাকাটা বাংলাদেশের নামে স্যাংশন হবে, সেই টাকাটা নষ্ট করবার কিন্তু কোনো রাইট তাদের নাই। হয়ত পদ্মা সেতু থেকে টাকা তারা বন্ধ করছে, টাকা কিন্তু উদ্ধার আমরা করতে পেরেছি।
“এবং এই টাকা কিন্তু অন্যান্য প্রজেক্টে ব্যবহার করতে পেরেছি। এটা কিন্তু করা যায়। এটা আমাদের অনেকে জানে না। জানি না, কেন জানে না।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের যারা অর্থনীতিবিদ বা আমাদের যারা কাজ করে তারা এটা কেন মাথায় রাখে না যে, এরা কোনো দাতা না। আমি তাদের কাছ থেকে ভিক্ষা নিই না।
“ব্যাংকের একটা অংশীদার হিসাবে আমরা লোন নিই। এবং সুদসহ সেই লোন আমি পরিশোধ করি। কাজেই, আমার নামে, বাংলাদেশের নামে যে টাকা হবে সেই টাকা তাকে দিতে হবে, সে বাধ্য। এটা টাকা কোনো দিন বন্ধ করতে পারবে না। কাজে একটা প্রজেক্টের টাকা বন্ধ হয়ে গেলে, সেই টাকা নিয়ে চলে যাবে সেটা কিন্তু যেতে পারে না।“
বিশ্ব ব্যাংকের কর্মপ্রক্রিয়ার বিষয় তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “বড় বড় জ্ঞানী-গুণীরা তারাও কিন্তু মনে করছেন, বিশ্ব ব্যাংকের টাকা বন্ধ হয়ে গেছে। কিসের জন্য? আমরাতো লোন নিচ্ছি এবং যে লোন বাংলাদেশের নামে স্যাংকশন হবে, সেই লোন কোনো না কোনোভাবে তাকে শোধ দিতেই হবে। এটা না দিয়ে পারে না। এই কথাটা মনে রাখবেন।”
এভাবে ঋণ নিয়ে সুদসহ তা পরিশোধের কারণে ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিশ্ব ব্যাংকের মত প্রতিষ্ঠানকে ’দাতা’ না বলে ’উন্নয়ন সহযোগী’ হিসাবে ডাকার প্রচলন করার কথা বলেন শেখ হাসিনা।
“৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে দাতা শব্দটা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। আমি বলেছি, কিসের দাতা, এরাতো উন্নয়ন সহযোগী। আমি লোন নিই, সুদসহ পরিশোধ করি। সুদের হার কম, এটা ঠিক। কিন্তু সুদতো দিয়েই আমরা টাকা পরিশোধ করছি।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা ভিক্ষা নিচ্ছি না। আমার মনে হয়, আমাদের সাংবাদিক বন্ধুদেরও এই বিষয়টি মাথায় রাখা উচিত যে, আমরা কিন্তু কারও কাছ থেকে ভিক্ষা নিই না।
“আমরা ঋণ নিই। হ্যাঁ স্বল্প সুদে। ওইটুকু সুবিধা, স্বল্প সুদে। কিন্তু সাথে সাথে আমরা শোধও দিই টাকাটা। কাজে এই জায়গায় কেউ আমাদের করুণা করে না। আমরা করুণা ভিক্ষা নিই না।”
ছিয়ানব্বইয়ের সরকারে বিশ্ব ব্যাংকের বিভিন্ন পরামর্শ সভার আয়োজন ঢাকায় নিয়ে আসার কথাও সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরেন আওয়ামী লীগ সভাপতি।
তিনি বলেন, “কনসালটেন্সি মিটিংয়ে আমরা সবসময় যেতাম। আমি বললাম কেন, ওরা এখানে এসে দিয়ে যাবে। তারপর থেকে আমি শুরু করলাম, তারা ঢাকায় এসে আমাদের লোনটা কি নিব, সেটা ঠিক করবে। বারবার আমরা যাব না। তো, তখন কিবরিয়া সাহেব অর্থমন্ত্রী, তাকে বলছিলাম, বারবার আমরা যাব কেন?
“আমরাতো লোন নিচ্ছি। তাদের গরজে তারা টাকা দেবে, কাজে এখানে এসে করুক। আপনি কনসালটেন্সি মিটিং ঢাকাতে করেন। এরপর ঢাকায় আমরা মিটিং করেছি। এই টেকনিক্যাল জিনিস জানা দরকার। আমাদের জুজুর ভয় দেখিয়েতো লাভ নেই।