আর ৪ মাস হলে দিপার সঙ্গে বিয়ের ১৬ বছর পূর্ণ হতো। বিয়ের আগে ওকে ভাবি ডাকতাম, ও ছিলো রফিক ভাবী। আমার অফিসের বস রফিক স্যার, যেমন অমায়িক, তেমনই স্মার্ট। উনাদের ২ টা বেবি, দিশা ক্লাশ ফোর এ আর দ্বীপ ক্লাশ টু’তে পড়তো…
শান্ত স্বভাবের কারনে সবার কাছে আমার অন্যরকম কদর, তার উপর ব্যাচেলর। ট্যুর, ফ্যামেলী প্রোগ্রাম কিংবা গেট টুগেদার সবখানেই আমি। আর ভাবীদের আক্রমণেরও যেন একটাই টার্গেট, তা এই অধম। সবার একটাই প্রশ্ন আমি কেন এখনো ব্যাচেলর? কখনো ফ্যামেলী বার্ডেন, কখনো ছ্যাঁকা খেয়ে ব্যাকা হয়ে আছি বলে এড়িয়ে যেতাম। তবুও ভাবীরা খোঁচা মারতে ছাড়েন না, হাসান ভাই, অন্য কোন প্রবলেম নেই তো…! লজ্জায় মুখ লাল হয়ে যেতো কিন্তু বলার উপায় ছিলো না।
রফিক স্যারের অন্যত্র বদলী হবার বছর খানেক পর একদিন দিপার কল, কী ব্যাপার ভাবী এতদিন পরে? হাসান ভাই, জরুরি কথা আছে, একটু আসতে পারবেন? কি যে বলেন ভাবী, শিয়র আসবো….
#Hasan Hafizur Rahman
অফিস শেষে বিকালে ওদের বাসায় গেলাম। সে বাসায় অনেক পরিবর্তন নজরে এলো, সব কিছুতেই মলীন একটা ভাব। যা শুনলাম, তারজন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না । স্যার বাসায় আসেন না, টাকা পয়সাও পাঠান না। তিনি সম্ভবতঃ লিভ টুগেদার করছেন। এদের কোনও খবর রাখেন না। ৫ মাস যাবত দিশা দ্বীপের স্কুল যাওয়া বন্ধ। শান্তনা দিলাম, কোনও চিন্তা করবেন না ভাবী সব ঠিক হয়ে যাবে। আর আমরা তো আছি, নাকি? মাস চলার মতো কিছু পকেটে রেখে বাঁকী সবটাই ওর হাতে তুলে দিয়ে এলাম…
পরের মাস থেকে দীশা দ্বীপের স্কুল যাওয়া শুরু হলো, ওরা অনেক ট্যালেন্ট। অফিস যাবার পথে আমি স্কুলে রেখে যেতাম, দুপুরে দিপা আনতো। দায়িত্বটা নিজের করে নিলাম, ওদেরকে নিজের ভাবতে ভালো লাগা শুরু হলো…
আমাকে নিয়ে দিপার টেনশনের শেষ নেই, একা থাকি, কি খাই, কাপড়-চোপড় কে পরিস্কার করে? বিছানাপত্র কে গোছায়? ওর দুশ্চিন্তা দেখে মেস ছাড়তেই হলো। এসব খবর অফিস পর্যন্ত গড়ালো। ক্যান্টিনে কলিগদের ফিসফাস আলাপ, শুধু এটুকু কানে এলো, গাই বাছুর একসাথে পেয়েছে, অনেক খরচ সেভ হয়েছে, তারপর সমবেত অট্টহাসি….
গলা দিয়ে খাবার নামতে চাইলো না। সব শুনে দিপা সে রাতেই আমরা কাজী অফিসে গেলাম।
ওর মাথার উপরে একটা ছাতা থাকার টেনশন পুরোপুরি দূর হলো…
#Hasan Hafizur Rahman
কৃষ্ণপক্ষ চলছে, আকাশে ঘোর অন্ধকার।
দূরের বিলবোর্ডের রঙ্গিন আলো দেখতে ভালোই লাগছিলো, এখন কেমন যেন বিরক্ত লাগছে। নিচের রাস্তায় কত লোক চলছে, কেউ হেঁটে, কেউ রিক্সায় গাড়িতে। উপর থেকে কাউকেই আপন মনে হচ্ছে না। সন্ধ্যা থেকে একাই ছাদে বসে, মাথাটা মোটেও কাজ করছে না। পাঁচ মাসের বাড়িভাড়া বাকি, বাড়িয়ালা বাসা ছাড়তে বলছেন। দিশার টিউশন ফি দেবার সময় ব্যাংকে জমা সবটাই শেষ। অফিসেও বেশকিছু ধারদেনা হয়েছে। দ্বীপের জব হয়ে গেলেই শোধ করার কথা ছিলো। ওর ফ্লাইং ক্লাবের ফি দেবার সময় কারটা বেচতে হলো। তখন থেকে অফিসের বাসে আসা যাওয়া শুরু করলাম। প্রথম প্রথম সংকোচ লাগতো, এখন গা সওয়া হয়ে গেছে। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতাম, গাড়িটা গ্যারেজে আছে, লোকাল মার্কেটে একটা পার্টস পাওয়া যাচ্ছেনা, বাইরে থেকে আনতে হবে। কিছুদিন পর আর কেউ কিছু জিজ্ঞেস করতো না…
ছমাস হলো, দ্বীপ প্রাইভেট এয়ার লাইন্সে ভালো জব পেয়েছে, দিশারও ইন্টার্নি শেষ। এ্যাফেয়ারের ছেলের সঙ্গেই ওর বিয়ের কথাবার্তা চলছে, ওর দু’ ব্যাচ সিনিয়র । ওদের মাঝেই নিজেকে খুঁজে পেয়েছিলাম, সন্তান জন্ম দেবার অক্ষমতা ভুলেই গিয়েছিলাম। সবাই বড় একটা বাসায় ওঠার কথা ছিলো…
©Hasan Hafizur Rahman
একটা কথা সবার কাছে লুকাতে পারলেও আমার ক্লাইন ফেল্টার্স সিনড্রোমের (নিঃষ্ফলা রোগ) কথা দিপার কাছে লুকানো সম্ভব ছিলো না। আজ দুপুরে কাজী অফিস থেকে রেজিষ্ট্রি চিঠি এসেছে, এখনো খুলে দেখিনি…
গত মাসে ওরা নতুন বাসায় উঠেছে, রফিক সাহেবও বাসায় ফিরেছেন…
কয়েকদিন ফেসবুকেও ঢোকা হয়নি, অনেক গুলো নোটিফিকেশন জমা হয়ে অছে। স্ক্রল আপ-ডাউন করতে গিয়ে, দ্বীপের একটা পোষ্টে নজর থমকে গেলো। খুব সুন্দর একটা ফ্যামেলী পিকচার পোষ্ট করেছে। ভাইবোন দু’পাশ থেকে ওদের বাবাকে ধরে আছে, পাশে সহাস্য দিপা। ক্যাপসনটাও বেশ সুন্দর, ” My Dad is the best dad in the World, Love u dad, ♥ Happy Father’s Day ♥…
Hasan Hafizur Rahman
লেখকঃ বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির আইন প্রশিক্ষক হাসান হাফিজুর রহমান।