তখনও আমাদের অঞ্চলে ক্যাসেট প্লেয়ারের প্রচলন হয়নি। গ্রামের বিবাহ, খৎনা অনু্ষ্ঠান কিংবা বাজারের হালখাতার দিনে মাইকে বাজানো হতো গ্রামোফোন রেকর্ড। জনপ্রিয় বাংলা সিনেমা “রুপবান” এর লং প্লে রেকর্ড আমার শিশুমনকে দারুণ আলোড়িত করতো। রুপবানের দুঃখের কাহিনী শুনে খুব কান্না পেতো, রুপবানের গল্পটি এরকম;
নিরাশপুর রাজ্যের বাদশা একাব্বর আর তার উজিরের মধ্যে কথোপকথন, বাদশা বলেন, ‘শোনো উজির, আমি শুনলাম প্রজারা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। কী ষড়যন্ত্র করছে এবং কেন করছে বলতে পারো?’ এ-প্রশ্নের উত্তর দিতে উজির কিছুটা আমতা-আমতা করেন। তখন বাদশা অভয় দিলে উজির বলেন, ‘কী বলব জাঁহাপনা, আপনার ছেলেমেয়ে নাই, আপনি আটকুঁড়ে। তাই প্রজারা বলছে, আপনার মুখদর্শনে অন্ন জোটে না, তাই প্রজারা এ রাজ্য ছেড়ে অন্য রাজ্যে চলে যাওয়ার কথা ভাবছে”
একথা শুনে মনের দুঃখে বাদশা স্বেচ্ছায় বনবাসে চলে গেলেন। বনে বাদশার সঙ্গে এক মুনির সাক্ষাৎ হয়। ঘটনাক্রমে মুনি বাদশাকে জানান, শিগগিরই বাদশা এক পুত্র সন্তানের বাবা হবেন। কিন্তু যেদিন পুত্রের বয়স বারো দিন হবে, ঐদিনই ছেলেটি মারা যাবে। শিশুটিকে বাঁচাতে হলে বারো বছরের এক মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে দিতে হবে এবং বিয়ের রাতেই তাদের বারো বছরের জন্য বনবাসে পাঠাতে হবে। তা না-হলে ওই শিশুর মৃত্যু হবে।
মুনির কথা শুনে বাদশা রাজ্যে ফিরে আসেন এবং সব কথা তাঁর স্ত্রী জাহানারাকে খুলে বলেন। সব শুনে জাহানারা বলেন, ‘খোদা, আমি মা হয়ে বারো দিনের ছেলেকে বনে পাঠিয়ে কেমন করে গৃহে থাকব? আমি এ শোক সহ্য করতে পারব না। তুমি একি করলে খোদা!
বাদশা জাহানারাকে শান্তনা দিয়ে কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমি সহ্য করব বেগম। তবু আমাদের আটকুঁড়ে নাম মুছে যাক’
কিছুদিন পর মুনির ভবিষ্যদ্বাণী সত্য প্রমাণিত হয়, বাদশা এক ফুটফুটে ছেলে সন্তানের বাবা হন। আর তখনই রাজ্যময় ছেলের জন্য বারো বছর বয়সী পাত্রী খুঁজতে থাকেন বাদশা। কিন্তু কোথাও মেলে না সেই পাত্রীর সন্ধান।
অবশেষে রাজা খবর পান, তাঁরই উজিরের বারো বছর বয়সী রূপবান নামের এক কন্যা আছে। উজিরকে তাঁর বারো দিনের ছেলে রহিমের সঙ্গে বার বছরের রূপবানের বিয়ের প্রস্তাব দেন; কিন্তু উজির বারো বছর বয়সী শিশুর সঙ্গে তাঁর মেয়ের বিয়ে দিতে কিছুতেই রাজি নন।
উজির একাব্বর বাদশার উদ্দেশ্যে বলেন, ‘বাদশার ছেলের সঙ্গে আমার মেয়ের বিবাহ, এর চেয়ে আনন্দের বিষয় আর কী আছে জাঁহাপনা, কিন্তু বিবাহ তো পুতুল খেলা নয় যে, হয় খেললুম, না-হয় ভেঙে ফেললুম। বারো দিনের শিশুর হাতে মেয়ে সমর্পণ করতে পারব না জাঁহাপনা, এ অসম্ভব কাজ আমার দ্বারা হবে না। কেননা আমি যে তার পিতা। নানা অনুনয়-বিনয় ও লোভ দেখানো সত্ত্বেও উজির যখন তাঁর মেয়েকে রহিমের সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজি হচ্ছিলেন না, তখন ক্ষুব্ধ বাদশা প্রহরী ডেকে উজিরকে বন্দি করেন। তাতেও কাজ না-হওয়ায় জল্লাদ ডেকে উজিরকে হত্যার আদেশ দেন। বাদশার এমন আদেশ যখন রূপবানের কানে পৌঁছে, তখন সে দৌড়ে এসে রাজার কাছে বাবার মুক্তি প্রার্থনা করে। তবে রাজা রহিমের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেই কেবল উজিরকে মুক্তি দেবেন বলে রূপবানকে জানান। রূপবান রাজার প্রস্তাবে রাজি হলে তবেই উজিরকে প্রাণভিক্ষা দেওয়া হয়। যুববাজ রহিম এর আয়ুর শেষদিনে রূপবানের সাথে বিয়ে সম্পন্ন হয়…
ওইদিনই বাসর শেষে ১২ দিন বয়সি স্বামী রহিমকে কোলে নিয়ে বনবাসের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে রুপবান। রাজ্য থেকে বেরিয়ে রূপবান এক নদীর ঘাটে এসে মাঝিকে পার করে দেওয়ার অনুরোধ করে। মাঝি দু-আনা পয়সা ছাড়া পার করবে না বলে জানালে রূপবান রাজি হয়, তবে নদী পার হওয়ার পর রূপবান তার আঁচলে বেঁধে রাখা স্বর্ণালঙ্কার বকশিস দেয়। মাঝি তা পিতলের টুকরো ভেবে তা এক পথিকের কাছে বিক্রি করে দেয়।
রূপবান রহিমকে নিয়ে বনের পথে দস্যুর কবলে পড়ে, তবে বনরাজাধিপতি জংলিরাজা এসে তাদের উদ্ধার করে। জংলিরাজা রূপবানের দুঃখ-কষ্টের কথা শুনে বনের মধ্যে রূপবান ও রহিমের বসবাসের জন্য একটি ঘর তৈরি করে দেন। সে-ঘরেই রূপবান বসবাস করতে শুরু করে। একদিন ঘরের উঠোনে শিশু রহিমকে ঘুম পাড়িয়ে রূপবান পানি আনতে ঘাটে যায়, ফিরে এসে দেখে এক হিংস্র বাঘ রহিমের দিকে এগোচ্ছে। রূপবান ভয়ংকর ওই দৃশ্য দেখে গান ধরে :
‘খেয়ো না খেয়ো না বাঘ রে,
ও বাঘ খেয়ো না মোর পতি রে
বনের বাঘ বাঘ রে
হাতে ধরি পায়ে ধরি রে,
ও বাঘ ছেড়ে দাও মোর পতি রে
বনের বাঘ বাঘ রে…
গান গাইতে গাইতে রূপবান তার ধর্মের বাবা জংলিরাজাকে ডাকে। রূপবানের করুণ গান শুনতে পেয়ে জংলিরাজা ছুটে এসে বাঘের সঙ্গে লড়াই শুরু করে, জংলিরাজার হাতে সঙ্গীত প্রেমী বাঘটি মারা যায়।
সময় গড়ায়, রহিম ধীরে ধীরে বড় হয়। তবে তার কাছে রূপবানের প্রকৃত পরিচয় অজানাই রয়ে যায়। রহিমের কাছে রূপবান নিজেকে তার দাসী বলে পরিচয় দেয়, সে রহিমকে ডাকে ‘দাদা’ আর রহিম তাকে ডাকে ‘দিদি’। রূপবান রহিমকে পাঠশালায় ভর্তি করিয়ে দেয়; কিন্তু বাদশাজাদা মেধাবী রহিমের সঙ্গে কোনোভাবেই পড়ালেখায় কুলিয়ে উঠতে পারছিল না ছায়েদ বাদশার মেয়ে সহপাঠী তাজেল। এটা জেনে ছায়েদ বাদশা পাঠশালার নানা কায়দায় রহিমকে পাঠশালা থেকে খেদানোর আদেশ দেন, সে অনুযায়ী পন্ডিত মশাই রহিমকে জরির পোষাক পরে ঘোড়ার চড়ে পাঠশালায় আসতে হুকুম করে। অন্যদিকে ছায়েদ বাদশার কন্যা তাজেল রহিমের প্রেমে পড়ে, নানা প্রলোভনে প্রেমের ফাঁদে ফেলার চেষ্টা চালায়…
একদিন ছায়েদ বাদশা রহিমের কাছে ঘোড়ার দৌড়ে হেরে তাকে পুরস্কৃত করার বদলে বন্দি করে ফেলেন। তাজেল বাবার কাছ থেকে রহিমকে মুক্ত করতে এসেও ব্যর্থ হয়। যথারীতি রূপবানের অনুরোধে জংলিরাজা ছুটে এসে ছায়েদ বাদশার কাছ থেকে রহিমকে উদ্ধার করে…
এরই মধ্যে রূপবান-রহিমের বনবাসের বারো বছর পূর্ণ হলে জংলিরাজা তাদের একাব্বর বাদশার কাছে নিয়ে যায় এবং বাদশা পুত্র ও পুত্রবধূকে বরণ করে নেন…
১৯৬৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত “রুপবান” সিনেমায় নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন কুষ্টিয়ার মেয়ে তন্দ্রা মজুমদার, তিনি সুজাতা নামে আত্মপ্রকাশ করে রাতারাতি তারকা খ্যাতি অর্জন করেন। রুপবান সিনেমা তৎকালিন বাংলাদেশে (পূর্ব পাকিস্তান) উর্দূ সিনেমার একচেটিয়া দাপট ঠেকিয়ে বাংলা সিনেমার ব্যাপক জনপ্রিয়তার সূচনা করে।
কাজের অবসরে আবারও প্রিয়জনের সাথে সিনেমা হলে যেতে মন চায়। আমাদের সিনেমা আবারও সেই ধারায় ফিরে আসুক, ফিরে আসুক বাংলা সিনেমা সেই সুদিন, স্মৃতিপটে অমর হয়ে থেকো দাইমা…
কিসের ফেসবুক, কিসের টুইটার গো
ও দাইমা, কিছুই ভালো লাগে না
আমার দাইমা, দাইমা গো….
লেখকঃ বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির আইন প্রশিক্ষক হাসান হাফিজুর রহমান।