ব্রিটিশ রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের শেষকৃতে অংশ নেওয়ার পর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
স্থানীয় সময় সোমবার রাত ১০টা ২৫ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার সকাল ৮টা ২৫ মিনিট) তিনি নিউ ইয়র্কের জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরে পৌঁছান।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মুহাম্মদ ইমরান এবং জাতিসংঘ বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি মুহাম্মদ আব্দুল মুহিত বিমানবন্দরে প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানান।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৭তম অধিবেশনে শেখ হাসিনা বক্তৃতা করবেন ২৩ সেপ্টেম্বর, এ বিশ্বসভায় এবারও তিনি বাংলাদেশের মানুষের বক্তব্য তুলে ধরবেন বাংলায়।
ইউক্রেইন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ‘একতরফা নিষেধাজ্ঞায়’ উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষতির কথা জাতিসংঘে তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী এবার সংকট সমাধানে আলোচনার উপর জোর দেবেন বলে ইতোমধ্যে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।
২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিউ ইয়র্কে অবস্থানকালে বেশ কয়েকটি উচ্চ পর্যায়ের অনুষ্ঠানেও যোগ দেবেন শেখ হাসিনা। বেশ কয়েকজন রাষ্ট্রনেতা এবং জাতিসংঘ মহাসচিব ও জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন।
গত ১৫ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ১০টায় বাংলাদেশ বিমানের একটি ভিভিআইপি ফ্লাইটে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে যুক্তরাজ্যের উদ্দেশে রওনা হন প্রধানমন্ত্রী ও তার সফরসঙ্গীরা।
রোববার লন্ডনের ওয়েস্ট মিনস্টার হলে রানির কফিনে শ্রদ্ধা জানান শেখ হাসিনা। সোমবার ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নিয়ে সন্ধ্যায় যুক্তরাষ্ট্রের পথে রওনা হন।
২০ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের আয়োজিত অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন এবং জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৭তম অধিবেশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন।
স্লোভেনিয়ার প্রেসিডেন্ট বরুত পাহোর এবং জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনার ফিলিপো গ্রান্ডির সঙ্গে এদিন শেখ হাসিনার দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হবে।
পরে তিনি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের প্ল্যাটফর্ম অব উইমেন লিডার্সের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে যোগ দেবেন প্রধানমন্ত্রী।
গত ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেন, উইমেন লিডার্সের সভায় প্রধানমন্ত্রী সংকট মোকাবেলায় তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে পারেন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীদের উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে তার সরকারের পদক্ষেপের কথা বলতে পারেন।
জাতিসংঘ অধিবেশনে উপস্থিত রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের সম্মানে ২০ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের দেওয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
চ্যাম্পিয়ন্স অব দ্য গ্লোবাল ক্রাইসিস রেসপন্স গ্রুপের (জিসিআরজি) উচ্চ পর্যায়ের সভা হবে ২১ সেপ্টেম্বর। এ গ্রুপে ছয়জন চ্যাম্পিয়নের মধ্যে ধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্যতম।
চলতি বছরের মার্চে জাতিসংঘ মহাসচিব খাদ্য, জ্বালানি ও আর্থিক বিষয়ে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় শেখ হাসিনাসহ মোট ছয়টি দেশের রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানগণের সমন্বয়ে এ গ্রুপটি গঠন করেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, “উচ্চ পর্যায়ের এ সভায় বর্তমান প্রেক্ষাপটে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী তার সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করবেন। উক্ত বৈঠকে জি-৭, জি-২০ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত থাকবেন।”
এদিন টেকসই আবাসন বিষয়ক পার্শ্ব অনুষ্ঠানেও অংশ নেবেন শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ এবং জাতিসংঘ আবাসন সংস্থা যৌথভাবে এর আয়োজন করছে।
কসভোর প্রেসিডেন্ট ভিজোসা ওসমানি-সাদরিউ, ইকুয়েডরের প্রেসিডেন্ট গুইলারমো লাসো এবং ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের নির্বাহী পরিচালক নির্বাহী পরিচালক ক্লস সোয়াবের সঙ্গে ২১ সেপ্টেম্বর দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার।
মোমেন জানান, কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে এবার কোনো পার্শ্ব অনুষ্ঠান জাতিসংঘ সদর দপ্তরের ভেতরে হবে না। তবে রোহিঙ্গা সমস্যা ও টেকসই আবাসন নিয়ে আলাদা দুটি অনুষ্ঠান আয়োজন করবে বাংলাদেশ।
পাশাপাশি ২১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সদর দপ্তরের ভেতরে পদ্মা বহুমুখী সেতু বিষয়ক একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনী আয়োজন করা হয়েছে।
রোহিঙ্গা বিষয়ক উচ্চ পর্যায়ের অনুষ্ঠানটি হবে ২২ সেপ্টেম্বর, প্রধানমন্ত্রী তাতে অংশ নেবেন।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ওআইসি সেক্রেটারিয়েট, কানাডা, সৌদি আরব, তুরস্ক, গাম্বিয়া, মালদ্বীপ, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়া রোহিঙ্গা বিষয়ক পার্শ্ব অনুষ্ঠানটি কো-স্পন্সর করবে।
জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনার, জাতিসংঘ মহাসচিবের মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূত, এবং আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার মহাপরিচালক অনুষ্ঠানে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ব্রিফ করবেন।
একই দিনে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিট্যান্স (এএমআর) বিষয়্ক একটি উচ্চপর্যায়ের সভা হবে, সেখানে কো-চেয়ার হিসেবে অংশ নেবেন প্রধানমন্ত্রী। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীদের আয়োজনে একটি গোলটেবিল বৈঠকেও তিনি যোগ দেবেন।
দেশের ব্যবসায়ীরা এ বৈঠকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের পরিবেশ ও সুযোগ-সুবিধাগুলো উপস্থাপন করবেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগ প্রস্তাব তুলে ধরবেন।
কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেন এদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করবেন। এছাড়া আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) মহাপরিচালক আন্তোনিও ভিতোরিনো, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রসিকিউটর করিম খান, মেটার নিক ক্লেগ সাক্ষাৎ করবেন বাংলাদেশের সরকারপ্রধানের সঙ্গে।
২৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে বক্তৃতা করবেন প্রধানমন্ত্রী। আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের বলিষ্ঠ অবস্থান, সন্ত্রাস ও সহিংস উগ্রপন্থার বিষয়ে বাংলাদেশের ‘জিরোটলারেন্স’ নীতি, সামুদ্রিক সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনা, নিরাপদ অভিবাসন অভিবাসীদের মৌলিক পরিষেবা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা, জলবায়ুপরিবর্তন ও এর প্রভাব, জলবায়ু ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, এবং ফিলিস্তিন সম্পর্কিত বিষয়সমূহ তার বক্তব্যে উঠে আসবে বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছিলেন।
১৪ সেপ্টেম্বরের সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধানের যে অবস্থান বাংলাদেশের রয়েছে, সে বিষয়ে এবারও জোর দেবেন প্রধানমন্ত্রী।
“করোনা মহামারীর ক্ষতি কাটিয়ে না উঠতেই ইউক্রেইন সংঘাত বিশ্বকে সামষ্টিক অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে যে প্রতিকূলতার মুখামুখি হতে হবে সে বিষয়টি এবং সংকট মোকাবেলায় একতরফা জবরদস্তিমূলক পদক্ষেপ কিংবা নিষেধাজ্ঞার মতো সিদ্ধান্ত না নিয়ে সংকট সমাধানে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধান এবং বহুপাক্ষিকতাবাদকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে গুরত্বারোপ করতে পারেন।”
এক প্রশ্নের জবাবে মোমেন সেদিন বলেন, “প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে পাবলিকলি বলেছেন, ইউক্রেইন যুদ্ধের পর থেকে বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞার কারণে, নিষেধাজ্ঞা যাদেরকে আঘাত করার জন্য করা হয়েছিল, তার পরিবর্তে বিশ্ববাসী এর ফলে কষ্ট পাচ্ছে, অসুবিধায় পড়েছে। বিভিন্ন দেশ এর জন্য অসুবিধায় পড়েছে।
“উদ্দেশ্য ছিল যাকে শাস্তি দেওয়ার, সে অতো অসুবিধায় পড়ছে কি-না, আমি জানি না। কিন্তু অন্যান্য লোকজন বহু কষ্টে আছে।… বিশেষ করে নিষেধাজ্ঞার কারণে আমাদের জনজীবনে মুদ্রাস্ফীতি, সাপ্লাই চেইন, ট্রানজেকশন চেইন এগুলোতে বেশ প্রভাব পড়েছে। তো, সেটাই দুঃখজনক। এই জন্যে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় যাতে সবার সাথে আলোচনার করে সিদ্ধান্ত নিলে পরে এটা আরও ফলপ্রসূ হবে এবং মানুষের অমঙ্গল কম হবে।”
নিষেধাজ্ঞার প্রভাবের পাশাপাশি বাংলাদেশের অভাবনীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং প্রযুক্তিখাত বিকাশে সরকারের কার্যক্রম প্রধানমন্ত্রী তার বক্তৃতায় তুলে ধরবেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “করোনাভাইরাসের মতো ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্যসংকট মোকাবেলার লক্ষ্যে টিকা এবং প্রতিষেধকের ন্যায্য ও আরও ন্যায়সঙ্গত বণ্টনের আহ্বান বক্তৃতায় পুনর্ব্যক্ত করতে পারেন শেখ হাসিনা।
“আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে উপায় খুঁজে বের করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আহবান জানাতে পারেন।”
২৪ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশিদের আয়োজনে অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন শেষ হাসিনা।
এবারের অধিবেশনে দ্য ফিউচার অব ডিজিটাল কোঅপারেশন: বিল্ডিং রেজিলিয়েন্স থ্রু সেইফ, ট্রাস্টেড অ্যান্ড ইনক্লুসিভ ডিজিটাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার এবং ‘বহুপাক্ষিকতাবাদ ও খাদ্য নিরাপত্তা’ বিষয়ক আলাদা দুটি উচ্চ পর্যায়ের সভা অনুষ্ঠিত হবে।
এ দুটি উচ্চ পর্যায়ের সভায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন শেখ হাসিনা। প্রথম সভায় প্রধানমন্ত্রীর তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় অংশ নিতে পারেন।
নিউ ইয়র্কের কর্মসূচি শেষে ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে ১ অক্টোবর ওয়াশিংটন ডিসি সফর করবেন প্রধানমন্ত্রী।