মানুষ বাঁচে কর্মের মধ্যে বয়সের মধ্যে নয়। কর্মই মানুষকে যুগযুগান্তর বাঁচিয়ে রাখে। মানুষের জন্য, জাতির জন্য যিনি অকাতরে জীবনকে বিলিয়ে গেছেন সেইই প্রকৃত মানুষ। তেমনি একজন মহৎ প্রাণ আলহাজ্জু মোঃ আব্দুল মজিদ, যিনি শুধু একটি নামে নয়, একটি প্রতিষ্ঠানও। সারাটি জীবন যিনি ছিলেন মানবসেবক, মৃত্যুর কয়েক মিনিট আগ পর্যন্ত যিনি নলতা কেন্দ্রীয় আহ্ছানিয়া মিশনে দুঃস্থ্য রোগীদের সেবার জন্য উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি কামনা করেন, ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পে ঔষধ দান করার জন্য। আত্মমানবতার সেবায় নিয়োজিত আলহাজ্জ মোঃ আব্দুল মজিদ সাহেব ১৯৩৪ সালের ৬ জানুয়ারি তৎকালিন খুলনা জেলার সাতক্ষীরা মহাকুমার অন্তর্গত দেবহাটা থানার সখিপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত, ধর্ণাঢ্য মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিল মেনহাজ উদ্দিন এবং মাতার নাম রওশন আরা বেগম। ছাত্র জীবনে তিনি খেলাধুলার প্রতি আগ্রহী ছিলেন। তিনি বিভিন্ন খেলায় পারদর্শী ছিলেন যেমন: ফুটবল ও ব্যাডমিন্টন, তিনি সখিপুর মাঠের মত বৃহৎ মাঠে বড় বড় খেলা পরিচালিত করেছেন। অত্যান্ত দক্ষতার সাথে। সাদা হুজ পরিপাটি টিশার্ট ও হাফপ্যান্ট পরে যখন মাঠে রেফারী হিসাবে বাঁশি বাজাতেন তখন সকলে জড়সড়ো হয়ে বসত। তিনি অত্যান্ত নীতিবান ও রাসভারী মানুষ ছিলেন যার কারণে যে কোন অন্যায় আবদার নিয়ে তার সামনে কেউ হাজির হতেন না। দুই ভাই এর মধ্যে তিনি ছিলেন ছোট। বড় ভাই আব্দুল করিম সাহেব ১৯৪৩ সাল থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত দীর্ঘকাল সখীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। আলহাজ্জ মোঃ আব্দুল মজিদ সাহেব ১৯৭৭ থকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত সখিপুর ইউনিয়ন পরিষদে সুনামের সাথে চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময়ে তিনি দেবহাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, সখিপুর সাব-রেজিষ্ট্রি অফিস, বিভিন্ন ব্যাংক ও পোস্ট অফিস স্থাপনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন এবং জমি দান করেন। তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়, হাইস্কুল, মাদ্রাসা তৈরীতেও সার্বিক সহযোগিতা ও জমি দান করেন। তিনি দেবহাটাবাসী কে জ্ঞানে পরিপূর্ণ ও উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করার মানষে এলাকার কিছু মানুষের সহযোগিতায় ১৯৮৫ সালে নিজ জমিতে গড়ে তোলেন খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা কলেজ। যা আজ জ্ঞানে গরিমায় শিক্ষা দীক্ষায় আলো ছড়িয়ে চলেছে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়, সহশিক্ষা কার্যক্রম, বিজ্ঞান বিষয়ক প্রদর্শনী সব কিছুতেই উপজেলা, জেলা, বিভাগ পেরিয়ে জাতীয় পর্যায়ে স্থান করে নিয়েছে। তারই হাতে নির্মিত প্রতিষ্ঠানের সকল শিক্ষক ও কর্মচারী যাদের মাথার উপর ছাতার ন্যায় অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করে আগলে রাখতেন সেই সকল শিক্ষক মন্ডলীর শিক্ষা দানে পরিপুষ্ঠ হয়ে আজ শিক্ষার্থীরা দেশের সকল প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, সকল মেডিকেল কলেজ ও সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ প্রতিনিধিত্ব করছে। তিনি যে কলেজ তৈরি করে ছিলেন সেটি আজ মহিরুহ আকার ধারণ করেছে। যেখানে অনার্স, ডিগ্রী, উচ্চমাধ্যমিক ও বিএম সকল বিষয় চালু আছে। কলেজটি আজ সরকারি করন হয়েছে। মজিদ সাহেবের স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানে আজ বাড়িতে বসে পান্তা খেয়ে ছাত্ররা অনার্স পাস করছে। শিক্ষার দ্যূতি তিনি জ্বেলেছেন সকলকে নিয়ে কিন্তু তিনি ছিলেন অগ্রদ্রুত। তারই প্রয়ান দিবসে মনে পড়ে কবির ভাষায়
“সাথে করে এনেছিলে মৃত্যুহীন প্রাণ
মরণে তাই তুমি করে গেলে দান”\
না মজিদ সাহেব মরেনি, আমাদের স্মৃতিতে যুগযুগান্তর চির অম্লান হয়ে বেঁচে থাকবেন তিনি\
মৃত্যুর আগে তিনি সখিপুর দীঘিরপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি, সখিপুর আহছানিয়া মিশনের সভাপতি, সখীপুর হাইস্কুলের পরিচালনা পরিষদের সদস্য, নিজ বাড়িতে নির্মিত মসজিদের আমৃত্যু সভাপতি এবং সখিপুর উদয়ন সংঘের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সেবামূলক কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখেন। সর্বপরি তিনি অবিভক্ত বাংলা ও আসামের শিক্ষা বিভাগের সহকারী পরিচালক, শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারক, সাহিত্যিক, দার্শনিক, সুফি-সাধক আলহাজ্জ হজরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) প্রতিষ্ঠিত “স্রষ্টার এবাদত ও সৃষ্টের সেবার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত নলতা কেন্দ্রীয় আহ্ছানিয়া মিশনের আমৃত্যু ২৭ বৎসরকাল সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। গত ২০১৯ সালের ১২ অক্টোবর ৮৬ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরন করেন। তিনি এক পুত্র ও চার কন্যা সন্তানের জনক। তার একমাত্র পুত্র ইকবাল মাসুদ ঢাকা আহছানিয়া মিশনের হেলথ সেক্টরের পরিচালকের দায়িত্বে আছেন। তার জামাতাদের মধ্যে ২ জন ইঞ্জনিয়ার, একজন শিক্ষা অফিসার ও একজন নৌবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
লেখক, মোঃ আবু তালেব, শিক্ষক, সরকারি খানবাহাদুর আহছানউল্লাহ কলেজ, সখিপুর, দেবহাটা, সাতক্ষীরা।