এ ভালোবাসা শতবর্ষি, সেই ১৮৯৫ সালে গুরুদেব লিখেছিলেন, “আমি চিনি গো চিনি তোমারে, ওগো বিদেশিনী, তুমি থাকো সিন্ধু পারে ওগো বিদেশিনী”। এ গানটি লেখার প্রায় ত্রিশ বছর পরে কোনো এক শারদপ্রাতে মাধবী রাতে কবিগুরু আর্জেন্টিনায় খুঁজে পান তাঁর সেই চেনা বিদেশিনী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো’ কে। যিনি কবির ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থের সূচনা, কিংবা অনুপ্রেরণার ‘বিজয়া’, তাঁর ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থটি উৎসর্গ করেছিলেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো কে, কেবলমাত্র দুটো শব্দেই লিখেছিলেন, ‘বিজয়ার করকমলে’। এই বিজয়া মানেই যে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো তাতে দ্বীমত নেই, বিজয়া/ ভিক্টোরিয়া যে নামেই ডাকি না কেন, কবিগুরুর সাথে তাঁর ছিল এক মধুর সম্পর্ক…
নভেম্বর ১৯২৪ সাল, নোবেল জয়ী কবি জাহাজেযোগে সাউথ আমেরিকার দেশ পেরুর পথে, স্পেনের কাছ থেকে পেরুর স্বাধীনতা লাভের শতবার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি তিনি। তাঁকে বহনকারি জাহাজ আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স আয়ারস বন্দরে যাত্রাবিরতীকালে কবির সাথে সাক্ষাৎ এর কথা। ইতিমধ্যেই ভিক্টোরিয়া ফরাসি অনুবাদে গীতাঞ্জলি পড়ে আলোড়িত, যেখানে যখনই রবীন্দ্র রচিত যা পেয়েছেন, তাই পড়তেন। কবিকে না দেখলেও কাব্য পাঠে অভিজাত সুন্দরী ৩৪ বছরের ওকাম্পো’র গভীর অনুরাগ জন্মেছে। এমনই পটভূমিতে পেরু যাত্রা পথে কবির বুয়েন্স আয়ারস এ যাত্রা বিরতির কথা..
ভিক্টোরিয়ার নিজের ভাষায়,” কবির ইংরেজীতে লেখা রচনাগুলো এবং ফরাসি অনুবাদ থেকে পড়ে আমরা যারা তাঁকে জানতাম, তাদের শুরু হলো প্রতিক্ষা। এখানে (বুয়েন্স আয়ারস) তাঁর আবির্ভাব এবছরের সবচেয়ে সেরা ব্যাপার।আর আমার পক্ষে এটা তো জীবনেরই সবচেয়ে বড় ঘটনা।
বুয়েন্স আয়ারস এ হোটেল প্লাজায় কবি যেদিন পৌঁছুলেন, সেদিনই সন্ধ্যায় ওকাম্পো বান্ধবীকে সাথে নিয়ে দেখা করতে যান। রিসেপশনে কবির সফরসঙ্গী লেনার্ড এল্মহার্স্ট জানালেন, কবির শরীরটা ভাল যাচ্ছে না, আপাততঃ তাঁর পেরু যাওয়া হচ্ছে না। ডাক্তারের পরামর্শে আবার ভ্রমণ শুরু করার আগে কবিকে নিরিবিলি পরিবেশে কিছুদিন বিশ্রাম নিতে হবে।ইতিমধ্যেই কবির অপারগতা পেরুর প্রেসিডেন্টকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমতাবস্থায় এলম্হার্স্ট কবির জন্য শহরতলীতে যুৎসই বিশ্রাম নিবাস খুঁজছেন।
ভিক্টোরিয়া আনন্দে উদ্বেলিত,কবির জন্য কিছু করার সুযোগ এসেছে তাঁর জীবনে। এলম্হার্স্টকে প্রস্তাব দিলেন, সম্মতি পেলে উপশহর সান-ইসিদ্রোতে কবির জন্য নিরিবিলি একটা নিবাসের ব্যবস্থা করতে চান।সেই মতো ওকাম্পো উচু ভূমিতে অবস্থিত একটি উপযুক্ত বাড়ির ঠিক করেন, বাড়িটির নাম “মিরালরিও” বা নদী দর্শন। বাড়ির সামনে পেছনে সবুজ আঙ্গিনা, পাশে স্নিগ্ধ নদী। সেটি আবার “ভিলা ওকাম্পো”র সন্নিকটে…
গুণমুগ্ধ ভক্ত-প্রেমিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো হোটেল কক্ষে কবিকে প্রথম-দর্শনেই বিমোহিত হয়েছিলেন। তার নিজ বর্ণনা থেকে,” এলম্হার্স্ট কবির স্যুইটে বসিয়ে রেখে বেরিয়ে গেলেন, অস্বস্তিকর এক নীরবতার মাঝে কাটছিল সেই মুহুর্তগুলো।ভাবছিলাম, ভীরু মানুষেরা সমস্ত জীবন ভরে যা চায়, ভাগ্য তা আয়ত্বের মধ্যে এনে দিলে সে তখন ভয় পেয়ে যায়। আমাকেও সে রকম ভয় চেপে ধরলো। ভাবলাম দেখা করে কাজ নেই, পালিয়ে যাই। প্রায় সাথে সাথেই ঘরে ঢুকলেন কবি। আহা ! কি নীরব, সুদুর, তুলনা হীন, বিনীত। তেষট্টি বছর বয়স, প্রায় আমার বাবার বয়েসী, অথছ কপালে একটিও রেখা নেই! গলদেশ অব্দি নেমে এসেছে তাঁর ঢেউ তোলা সাদা চুলের রাশি। শুভ্র দাড়ি-গোঁফে মুখের নিচের দিকটা আড়ালে, আর তারই ফলে ওপরের অংশ হয়ে উঠেছে আরো দীপ্যমান। তাঁর সুন্দর কালো চোখ, নিখুঁত টানা টানা ভারী চোখের পাতাজোড়া সমগ্র মুখাবয়বের এক অবিশ্বাস্য সৌন্দর্য রচনা করেছে। তাঁর সজীব চোখজোড়া, দীর্ঘদেহ, শোভন চলন। তাঁর প্রকাশময় দুটি অতুলনীয় হাতের শান্ত সৌন্দর্য যেন অবাক করে দেয়! মনে হয় যেন এদের নিজেদেরই কোনো ভাষা আছে।
এদিকে “মিরালরিও” বাড়িতে আসার পরদিনই, ১২ই নভেম্বর ১৯২৪, কবি-প্রেমিক তাঁর ভক্ত ওকাম্পো’র কথা মনে করে লিখলেন “বিদেশী ফুল” কবিতাটি,
হে বিদেশী ফুল, যবে আমি পুছিলাম-
‘কী তোমার নাম’,
হাসিয়া দুলালে মাথা,
বুঝিলাম তরে, নামেতে কী হবে।
আর কিছু নয়,
হাসিতে তোমার পরিচয়।
হে বিদেশী ফুল,
যবে তোমারে বুকের কাছে ধরে
শুধালেম ‘বলো বলো মোরে
কোথা তুমি থাকো’,
হাসিয়া দুলালে মাথা,
কহিলে ‘জানি না, জানি নাকো’
কবির বিশ্রামে যেন কোনো বিঘ্ন না ঘটে ভিক্টোরিয়া সে ব্যপারে খুবই সচেতন ছিলেন। তাঁর ভাষায়, “ভয় হতো যে সব সময় আমি ওখানে থাকলে ওঁর অসুবিধা হতে পারে। কখনও তাই দূরেই থাকতাম, যেতাম না ওঁকে দেখতে। ওঁর ভালর জন্য নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতেও আমি প্রস্তুত ছিলাম। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো তার Tagore en las barrancas de San Isidro বা সান ইসিদ্রো উপত্যকায় টেগোর বইতে লিখেছেন, “একদিন বিকেলে কবির ঘরে আমি ফুল সাজাতে গেলাম। দেখলাম কবি মাথা নীচু করে লিখছেন। আমি একটু নীচু হয়ে তাঁর সামনে দাঁড়ালাম। একটি হাত বাড়িয়ে মানুষ যেভাবে গাছের একটি ফল কে ধরে ঠিক তেমনি ভাবে কবি আমার একটি (*..*)ওপর হাত রাখলেন..” । এই ঘটনায় প্রথমে হতবাক! পরে অনুভব করলাম এটা একটা পবিত্র ভাললাগা। ঐ একদিনই, আর কোনদিন নয়। শুধু প্রতিদিন কবি আমার গালে ও মস্তকে চুম্বন করতেন…”
এই সব ‘কাছে-থাকা’, আর ‘দূরে-যাওয়া’ নিয়ে কবির সাথে ওকাম্পো’র যখন মান-অভিমানের ব্যাপার ঘটতো, তখন এলম্হাস্টকে তা সামলা বার দায়িত্ব নিতে হতো। প্রায় দুমাস বুয়েন্স আয়ারস -এ থাকবার সময়কালে কবি মোট ২২টি কবিতা লেখেন। একই বাড়িতে থেকেও চিঠি লিখতেন ভিক্টোরিয়াকে। এমনই একটি চিঠির অংশবিশেষ ”গত রাতে তোমার অতিথি সেবা নিয়ে আমি যতটুকু বলেছি, তা যে আমার মনের কথার অতি সামান্য অংশ; আশা করি তুমি তা বুঝে থাকবে। জীবনের যশ ও খ্যাতি, ব্যক্তি আমাকে নি:সঙ্গ করে রেখেছে। সমাজে আমার গুরুত্ব যতটা বেড়েছে, আমি ততটাই একাকিত্বের গহবরে ডুবেছি। দীর্ঘদিন ধরে আমি যা চেয়ে আসছি, তা কেবল উপযুক্ত কোনো নারীর প্রেমের মধ্যেই পাওয়া যেতে পারে। আজ আমি অনুভব করছি, যেন সেই মূল্যবান উপহারটি আমি পেয়েছি…
প্রায় দুমাস বাদে ৩ জানুয়ারী ১৯২৫, রবীন্দ্রনাথ ও এলমহার্স্ট বুয়েন্স আয়ারস থেকে জাহাজে চড়ে ইউরোপের উদ্দেশ্যে রওনা হন। ওকাম্পোর চেষ্টা ছিলো সান-ইসিদ্রোতে রবীন্দ্রনাথকে আরো কিছুদিন আটকে রাখা! সুখস্মৃতির উপহার স্বরূপ “মিরালরিও” বাড়িতে যে সোফাটিতে কবি আরাম করে বসতেন, ভিক্টোরিয়া তা জাহাজে তুলে দিতে চাইলেন। কিন্তু কেবিনের দরজা দিয়ে কিছুতেই ছোফাখানি ঢুকছিলো না। অবশেষে বিশেষ ব্যবস্থায় দরজার কব্জা খুলে তা ঢোকানো হয়। দীর্ঘ পথ ঘুরে সেই সোফা শান্তিনিকেতনে পৌঁছে। কবি বাকি জীবন সোফাটিতে বসেছেন। মৃত্যুর কিছুকাল আগে সেই আসনটির উদ্দেশ্যে তিনি দুটি কবিতা লেখেন। তার একটি এরকম,
আরো একবার যদি পারি
খুঁজে দেব সে আসনখানি
যার কোলে রয়েছে বিছানো
বিদেশের আদরের বাণী।
বিদেশের ভালোবাসা দিয়ে
যে প্রেয়সী পেতেছে আসন
চিরদিন রাখিবে বাঁধিয়া
কানে কানে তাহারি ভাষণ….
সান-ইসিদ্রোতে বসবাসের এই স্বল্প সময়ের মধ্যেই ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সাথে রবীন্দ্রনাথের প্রীতিময় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কবি তাঁকে ‘ভিক্টোরিয়া’ নামে না ডেকে বাংলা ভাষান্তরে ‘বিজয়া’ বলে ডাকতেন। আর সে ভালবাসাকে চিরস্থায়ী করতে কবি তাঁর পূরবী কাব্যগ্রন্থ ভিক্টোরিয়াকে উৎসর্গ করে লেখেন, “বিজয়ার করকমলে”….
*** শতবর্ষ পূর্বে যে ভাবে সেবা দিয়ে কবিকে মুগ্ধ করেছে বিজয়া,, আজ পায়ের যাদুতে আমায় মুগ্ধ করেছে তাঁরই উত্তরসূরী লিওনেল মেসিরা,, পুরোনো সে প্রেম ঢাকা পড়েনি আজও নব প্রেমজালে,, বিজয় মাল্য শোভিত হোক বিজয়া উত্তরসূরিদেরই গলে…. Vamos Argentine…In you I put my trust
লেখকঃ বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির আইন প্রশিক্ষক হাসান হাফিজুর রহমান।