অবসরপ্রাপ্ত গানের মাষ্টার ফ্রেন সেলাক, ক্রোট, যাকে মনে করা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান মানুষ। মৃত্যুকে দিয়েছেন বারবার ফাঁকি আর জিতেছেন জ্যাকপট…
সূচনা ১৯৬২ সালের জানুয়ারীতে, প্রচন্ড শীতের রাতে সারায়েভো থেকে দুব্রভনিক যাওয়ার পথে ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে বরফ গলা নদী নেরেৎভা তে পড়ে যায়। স্পটে ১৭ জনের সলিল সমাধি হলেও এক হাত ভাঙ্গা আর শরীরে ক্ষত নিয়ে সাঁতরে তীরে উঠে আসেন ফ্রেন সেলাক। এ সময় এক বৃদ্ধ যাত্রীর প্রাণও বাঁচান তিনি।
বছর বাদে ডগলাস ডিসি-৮ বিমানে জাগরেভ থেকে রিইয়িকা যাচ্ছিলেন ফ্রেন সেলাক। হঠাৎ উড়ন্ত বিমানটির দরজা খুলে পড়ে যায়। ভূপাতিত হওয়ার আগেই তীব্র বাতাসের টানে পড়ন্ত বিমান থেকে ছিটকে পড়ে যান তিনি, পড়বি তো পড়, একেবারে বিশাল খড়ের গাদায়!! প্লেনের পাইলট ও ক্রুসহ ১৯ জনের ঈশ্বরের প্রিয় খাতায় নাম উঠে। আশ্চর্যজনক ঘটনাটি গিনেস বুক অফ রেকর্ডসে স্থান পায়।
এরপর ১৯৬৬ সালে, বাসযোগে ফ্রেন স্প্লিট শহরে যাচ্ছিলেন, সেটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নদীতে পড়ে যায়।ফ্রেন সেলাক সাঁতরে তীরে উঠলেও এ যাত্রায় চারজন নিহত হয়। এর আগে অবশ্য তার ১৯৫৭ সালে একবার বাস সহ নদীতে পড়ে সাঁতরে তীরে উঠার পুরোনো অভিজ্ঞতা ছিলো, বাস ড্রাইভার বন্ধু আহমেত রাকিয়া’তে (আপেল পচিয়ে ঘরে বানানো শরাব) গলা না ভিজিয়ে নাকি কখনই স্টিয়ারিং ধরতো না।
চার নম্বর বিপদটি আসে ১৯৭০ সালে, যে গাড়িতে করে হাইওয়েতে যাচ্ছিলেন তিনি, হঠাৎ ইঞ্জিনে আগুন ধরে যায়।গ্যাস ট্যাঙ্ক বিস্ফোরণের ক্ষণ পূর্বে সেলাক চলন্ত গাড়ি থেকে রাস্তায় গড়িয়ে পড়েন।
এর তিন বছর পর, একদিন চলন্ত গাড়ির জ্বালানী পাম্প ফুটো হয়ে ফুটন্ত গরম তেল স্প্রে হয়ে গায়ে পড়ে, এতে সমস্ত চুল পুড়ে সাবাড়! মস্তক ফাঁকা মাঠ!!
ষষ্ঠ বিপদ আসে ১৯৯৫ সালে, জাগরেভের রাস্তায় বাসের সঙ্গে ধংঘর্ষ (বিঃ দ্রঃ ইহা একটি অভিধান বহির্ভূত শব্দ) হয়ে প্রিয় স্কোডা গাড়িটি চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেলেও যথারীতি অক্ষত থাকেন ফ্রেন সেলাক!
পরের বছর, ১৯৯৬ সালে জাগরেভের পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালাচ্ছিলেন ফ্রেন সেলাক, পাহাড়ের বাঁকে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর একটি ট্রাক সোজা তার স্কোডাকে ধাক্কা দেয়। রোড রেলিং ভেঙ্গে গাড়ি নিচে পড়তে থাকে, কোনরকমে দরজা খুলে বাইরে ঝাঁপ দেন তিনি। ভাগ্যক্রমে পাহাড়ের ঢালুতে গজানো গাছের ডাল ধরে ঝুলতে থাকেন আর গাড়িটি ৩০০ ফুট নিচে পড়ার পর তা বিস্ফোরিত হয়ে চারিদিকে আগুনের গোলা ছুটে যেতে দেখেন এই যমের অরুচি…!
পরবর্তি কুড়ি বছর জীবনে তেমন কোনো বিপর্যয় আসেনি এই বরপুত্রের। পূর্বের ৪ টি বিয়ে ব্যর্থ হলেও এবার সুখের ঠিকানা খুঁজে পান। মালা বদল করেন কুড়ি বছরের ছোট ক্যাথরিনার সাথে। ৭৩ তম জন্মদিনের ২ দিন পর জিতেন জ্যাকপট এক দশমিক এক মিলিয়ন ডলার (এগার লক্ষ দশ হাজার ডলার)। সুখী দাম্পত্যের আশায় হিপের সার্জারি করিয়ে নেন। টাকাকড়ি কিংবা বোনাস লাইফ নয় পঞ্চমী ক্যাথেরিনাকেই জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া মনে করতেন। এক সময় উপলব্ধি করেন টাকায় কখনো সুখ কেনা যায় না, তাই ব্যক্তিগত দ্বীপ বিলাসবহুল গাড়িবাড়ি সব বিক্রি করে দিয়ে জাগরেভের নিকটবর্তী পেত্রিনিয়া গ্রামে নিরিবিলি পরিবেশে ছোটকি’কে (অভিধান বহির্ভূত শব্দ) নিয়ে বসবাস করতে থাকেন…
১৪ই জুন ১৯২৯ তারিখে তদানিন্তন যুগোস্লাভিয়ার ক্রোয়েশিয়া প্রদেশের ধীবর বাবা অন্তঃস্বত্ত্বা মাকে সাথে নিয়ে সাগরে মাছ ধরার সময় প্রসব বেদনা শুরু হয়। নৌকা কূলে ভেড়ার আগেই ৭ পাউন্ড ওজনের দূর্বল শরীর নিয়ে দুনিয়া দেখেন ফ্রেন সেলাক। নবজাতকের নড়াচড়া নেই দেখে হাসপাতাল তাকে ফেরত দিলে মা বাবা তাকে একটি সার্টে জড়িয়ে চার্চের বারান্দায় শুইয়ে রাখেন, গায়ে পানি ছিটানোর সময় নড়াচাড়া দেখে বাড়ি নিয়ে যান। সেই শিশুটিই অনেক বিপর্যয় পেরিয়ে একসময় সৌভাগ্যের বরপুত্র হয়ে ওঠে, মৃত্যুঞ্জয় সাতাশি ছুয়ে (৩০ নভেম্বর ২০১৬) যমের রুচি বদল হতে দেখেন…
লেখকঃ বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির আইন প্রশিক্ষক হাসান হাফিজুর রহমান।