বেশভূষায় একজন কেতাদুরস্ত মানুষ। ভাবগাম্ভীর্যে আকর্ষণীয় ও প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। কিন্তু আচরণে সদাশয়- হতদরিদ্র মানুষের কষ্ট লাঘবে নাম নিবেদিতপ্রাণ, নৈবেদ্যজীবন। আলহাজ্জ মুহাম্মদ সেলিমউল্লাহ একজন কর্মবীর, একজন নক্ষত্র-মানুষ! সাতক্ষীরার মানুষ নন, অথচ সাতক্ষীরাবাসীর কাছে তিনি সর্বজনবিদিত, আহ্ছানিয়া মিশন পরিবারে তিনি সর্বজনশ্রদ্ধেয় এবং জেসন গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ পরিবারে তিনি স্বশ্রদ্ধায় উচ্চারিত নাম। এই আলোকিত মানুষটি গতরাতে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর।
মুহাম্মদ সেলিমউল্লাহর জন্ম ১৯৩৭ সালের ৭ এপ্রিল কলকাতা মহানগরীতে। ধনাঢ্য ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান তিনি। কলকাতায় লেখাপড়া শেষে বিলেতে পাড়ি জমিয়েছিলেন। সেখানে ফার্মাসীতে স্নাতক ও স্নাতোকোত্তর পাশ করে একই বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করেন আমেরিকা থেকে। ইতোমধ্যে দেশবিভাগের সময় পরিবার ঢাকায় স্থায়ী হয়। আমেরিকা থেকে ঢাকায় ফিরে পারিবারিক ব্যবসায় মনোযোগী হন। ১৯৫৬ সালে ঢাকায় ঔষধ ইন্ডাস্ট্রি খুলে বসেন। স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭২ সালে জেসন ফার্মাসিটিক্যাল লি. নামে নতুনভাবে যাত্রা শুরু করে জেসন গ্রুপ। স্বাধীন বাংলাদেশে নিত্য প্রয়োজনীয় ও জরুরী ঔষধ সরবরাহে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল জেসন গ্রুপ।
সত্তরের দশকে একান্তই কৌতুহল বশত নলতা শরীফে যান। ততদিনে নলতা শরীফে ছুফী সাধক হজরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) ইহলোক ত্যাগ করেছেন। কিন্তু হজরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) এর আর্দশ ও দর্শনে আপ্লুত হয়ে আহ্ছানিয়া মিশনের সাথে দারুণভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন তিনি। সেই থেকে আমৃত্যু আকড়িয়ে-আগলিয়ে রেখেছিলেন আহ্ছানিয়া মিশন। মিশন পরিচালনায় বিভিন্ন কার্যনির্বাহী কমিটিতে নানা দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০১ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত টানা ১৯ বছর তিনি নলতা কেন্দ্রীয় আহ্ছানিয়া মিশনের সভাপতির দায়িত্ব অত্যন্ত সুচারুভাবে পালন করেছেন। এর আগে ১৯৮৩ সাল থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত একযুগ ধরে তিনি ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের সভাপতির পদ অলঙ্কৃত করেন। আমৃত্যু তিনি ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের কার্যনির্বাহী সদস্য এবং নলতা কেন্দ্রীয় আহ্ছানিয়া মিশনের এ্যাডহক কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন।
আলহাজ্জ মুহাম্মদ সেলিমউল্লাহ আহ্ছানিয়া মিশনের জন্য অত্যন্ত নির্মোহ ও নিবেদিত কর্মী ছিলেন। ঢাকায় বসবাস করলেও আহ্ছানিয়া মিশনের সকল অনুষ্ঠানে তিনি অংশগ্রহণ করতেন। এমনকি মাসে পাঁচ-সাতটি অনুষ্ঠান থাকলেও তিনি প্রতিটি অনুষ্ঠানে ঢাকা থেকে নলতা শরীফে ছুটে আসতেন। আহ্ছানিয়া মিশনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনকালে তিনি নলতা শরীফের কোন অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত থেকেছেন- এমনটি হয়নি। এর বাইরে বছরজুড়ে দেশব্যাপী বিভিন্ন শাখা মিশন বা আহ্ছান-অনুরাগী যে কোন মানুষের ব্যক্তিগত আমন্ত্রণের তিনি কখনো অনুপস্থিত থাকতেন না। আহ্ছানিয়া মিশনের জন্য তিনি যাবতীয় ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক ব্যস্ততা উপেক্ষা করতেন। মিশনের জন্য তাঁর নিবেদন ছিল কিংবদন্তিতুল্য! কেন্দ্রীয় মিশনের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন শাখা মিশনের অবকাঠামোগত ও সাংগঠনিক উৎকর্ষতায় তিনি আর্থিক ও আত্মিক দানে অত্যন্ত উদার ছিলেন। অসংখ্য মিশনের ভবন নির্মিত হয়েছে তাঁর সহায়তায়। বার্ধক্যও তাঁকে ক্লান্ত করতে পারেনি। জীবনের শেষ সময়ের অধিকাংশ দিনগুলি তাঁর কেটেছে নলতা শরীফে।
দেশের ধনাঢ্য এই ব্যবসায়ী ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু ও দানশীল। সম্পদ ও আভিজাত্য তাঁকে অহংকারী করতে পারেনি। সাতক্ষীরার মানুষের কাছে তিনি দানবীরখ্যাত। নিজ উদ্যোগে আহ্ছানিয়া মিশনের মাধ্যমে হাজার হাজার গৃহহীনকে তিনি গৃহ নির্মাণ করে দিয়েছেন। লক্ষ মানুষের কাপড়ের ব্যবস্থা করেছেন। অসংখ্য অসহায় ও অস্বচ্ছল পরিবারে বছরজুড়ে নিয়মিত চাল-ডালের ব্যবস্থা করেছেন। অসংখ্য রোগীকে ঢাকায় নিয়ে নিজ দায়িত্বে রেখে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। অসংখ্য দূরারোগ্য রোগীর জীবনব্যাপী ব্যয়বহুল ঔষধ সরবরাহ করেছেন। প্রতি বছর রমজান মাসে তিনি যখন নলতা শরীফে আসতেন তখন জেসন গ্রুপের কাভার্ডভ্যানগুলো ভরে শাড়ী-লুঙ্গি আর পাঞ্জাবী আনতেন। ঈদের আগে এই হাজার হাজার কাপড় গরীব মানুষের মাঝে বিতরণ করে তবেই ঢাকায় ফিরতেন। এর বাইরে যখনই নলতা শরীফে যেতেন তখনই বস্তা বস্তা ঔষধ-পত্র বিতরণ করতেন। প্রতিবার ফেরার সময় অনেকগুলো রোগীর চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়ে, রোগীগুলোকে ঢাকায় আনতেন। ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে তাদের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা করাতেন নিজ খরচে।
▪️
আলহাজ্জ মুহাম্মদ সেলিমউল্লাহ ছিলেন শিক্ষানুরাগী মানুষ। অসংখ্য গরীব ও মেধাবী শিক্ষার্থীর খরচ বহন করতেন তিনি। এছাড়া বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাঁর সহায়তায় সমৃদ্ধ হয়েছে। তিনি নলতা আহ্ছানিয়া মিশন রেসিডেন্সিয়াল কলেজের পরিচালনা কমিটির দাতা সদস্য, নলতা আহ্ছানিয়া দারুল উলুম ফাজিল মাদ্রাসার সভাপতি, খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা প্রি-ক্যাডেট স্কুলের সভাপতি, আহ্ছানিয়া-সেলিমউল্লাহ প্রি-ক্যাডেট স্কুলের সভাপতি ছিলেন। সাতক্ষীরার অনেক মানুষকে তিনি জেসন গ্রুপে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন।
মুহাম্মদ সেলিমউল্লাহ অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন। তিনি ছিলেন আশেকে রাসুল ও আশেকে ওলী। চর্মচক্ষে হজরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) কে না দেখলেও তার আদর্শে আসক্ত হয়ে পরবর্তী জীবন আহ্ছানিয়া মিশনে নিবেদন করেন। দরবার শরীফের সর্বজনশ্রদ্ধেয় খাদেম সাহেব মৌলবি আনছারউদ্দীন আহমদ এবং মিশনের সম্পাদক আলহাজ্জ মো. আব্দুল মজিদ সাহেবের সাথে তিনি পারস্পরিক ত্রিমাত্রিক ভূমিকা পালন করেন। আহ্ছানিয়া মিশন পরিবারে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর অবস্থান অপূরণীয়।
৩০ এপ্রিল রাত ২ টা ৪০ মিনিটে মুহাম্মদ সেলিমউল্লাহ আমাদের ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। আগামী কাল ১ মে দুপুরে নলতা শরীফে জানাজা শেষে নলতা শরীফেই তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন। তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। মহান আল্লাহ তাঁর ত্যাগ ও নিবেদনের বিনিময়ে জান্নাতুল ফেরদৌস নসীব করুন। আহ্ছানিয়া মিশন পরিবার, তথা নলতা শরীফ ও সাতক্ষীরার মানুষ তাঁকে আজীবন গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করবে।
লেখকঃ মো. মনিরুল ইসলাম
পরিচালক
খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা ইনস্টিটিউট