মাজহারুল রাসেল : জন্মদিন,বিবাহবার্ষিকীর মতো দিনগুলো কেক কেটে উদযাপন বর্তমান জীবনে এখন খুব সাধারণ ঘটনা। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কেক বিক্রি হয় এসব উপলক্ষ ঘিরে। পরিচিত ব্র্যান্ড ছাড়াও পাড়া-মহল্লায় রয়েছে অনেক দোকান,সেখানেও পাওয়া যাচ্ছে বাহারি নানান কেক।
সুপরিচিত পেস্ট্রিশপে মান ভেদে প্রতি পাউন্ড ৫০০ থেকে ১০০০ টাকায় কেক বিক্রি হয়। পাড়ার বেকারি ও দোকানে এসব কেক মেলে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা পাউন্ড হিসেবে। অপেক্ষাকৃত কম দামের কারণে নিম্ন আয়ের মানুষই এসব কেকের প্রধান ক্রেতা।
এত কম দামে কেক কীভাবে তৈরি হচ্ছে তা অনুসন্ধানে সোনারগাঁয়ে মোগরাপাড়া ইউনিয়নের বাড়িমজলিস গ্রামে আল আমিনের কারখানায় গিয়ে দেখা গেছে ভড়কে যাওয়ার মতো পরিবেশ। ভয়ংকর অস্বাস্থ্যকর, নোংরা পরিবেশের মাঝে ক্ষতিকর উপকরণ ও রং দিয়ে তৈরি হচ্ছে এসব কেক।
কারখানার গেট দিয়ে ঢুকে দেখা যায় শত শত কেকের বাক্স। নানান আকৃতির বাক্সগুলোর ডিজাইন মনকাড়া। পাশেই ৫ টি কক্ষ ভাড়া নিয়ে চলছে আল-আমিনের কেক তৈরির কারখানা।
কারখানার কর্মীদের দম ফেলার ফুরসত নেই। কেউ কেকের ডেকোরেশন করছেন, কেউ ক্রিম তৈরি করছেন, আবার কেউ ব্যস্ত প্যাকিং নিয়ে। বিভিন্ন রঙের কেক দেখলেই জিভে পানি এসে যায়।
তবে চারদিকে অবিশ্বাস্য নোংরা ও দুর্গন্ধময় পরিবেশ। কারখানার ৫টি কক্ষই নোংরা ও স্যাঁতসেঁতে। কেকের খামির তৈরির জায়গাটির পাশেই আবর্জনার স্তূপ।পুরো কারখানা চষে বেড়াচ্ছে তেলাপোকা, মাছি ও পিঁপড়া।কেক যেখানে ডেকারেশন করা হয় তার পাশেই বাথরুম।
ভেতরের দিকের একটি কক্ষ কেক তৈরির মূল জায়গা। সেখানে আছে একটি গ্যাস ওভেন, চুলা ও খামির তৈরির মেশিন। মাটিতে একটির ওপর আরেকটি করে অনেকগুলো ট্রেতে রাখা আছে তৈরি করা কেক। এগুলোর ওপর হামলে পড়ছে মাছি। খামির তৈরির মেশিনের সঙ্গে রাখা ডাস্টবিনে ডিমের খোসাসহ অন্য আবর্জনা উপচে পড়ছে।
এর পাশেই একটি পাত্রে দেখা গেল ‘চকলেট ক্রিম’। ডালডার সঙ্গে রং মিশিয়ে কয়েক দিন আগে তৈরি করা হয়েছে এই কথিত চকলেট ক্রিম। ওই কক্ষেই ডালডার মজুত ও বালতি ভর্তি লাল, হলুদ, সবুজ নানা রঙের বিভিন্ন ক্রিমও রয়েছে। এগুলো দিয়ে ময়দার তৈরি কেকের ওপর বাহারি নকশা করা হয়।
যে কক্ষে ডেকোরেশনের কাজ চলে সেখানে ফুড কালার, কোকো পাউডার থাকলেও একটি বাক্সে দেখা গেল মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর ইন্ডাস্ট্রিয়াল কালার। এই রং মিশিয়েই বালতিতে নানা রঙের ক্রিম তৈরি করছেন কারখানার কর্মীরা।
পেছনের এই ভয়ংকর ধাপগুলো পেরিয়ে সুসজ্জিত কেকগুলো জায়গা পাচ্ছে আকর্ষণীয় বাক্সে।
এসব কেক সংরক্ষণের রেফ্রিজারেটরের দরজা খুলতেই আরও আতঙ্ক জাগে। কেকগুলোর সঙ্গেই রাখা হয়েছে কাঁচা মাছ-মাংস ও মসলা।
কারখানাটির কর্মচারীরা জানান,কয়েক বছর ধরে চলছে এই কারখানা। প্রতিদিন ২৫০ থেকে ৩০০ পিস কেক সরবরাহ করা হয় সোনারগাঁও বন্দর ও গজারিয়ার বিভিন্ন দোকানে। বিভিন্ন কনফেশনারি ও বেকারি দোকানিরাই তাদের প্রধান ক্রেতা। কারখানা থেকে প্রতি পাউন্ড কেক ১০০ টাকা করে বিক্রি হয়। আর সেগুলো বেকারি ও কনফেকশনারিতে বিক্রি হয় ২০০ থেকে ২৫০ টাকা পাউন্ড হিসাবে।
কেক তৈরির প্রক্রিয়া জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কারখানার এক কর্মী নিউজবাংলাকে জানান, ময়দার সঙ্গে চিনি, ডিম ও তেল মিশিয়ে খামির তেরি করে ওভেনের মাধ্যমে মূল কেক তৈরি করা হয়। এরপর সেগুলো নানা আকৃতিতে কেটে তার ওপরে ক্রিম দিয়ে ডেকোরেশন করা হয়।
এই কারখানায় ভ্যানিলা ও চকলেট ফ্লেভারের দুই ধরনের বেসিক ক্রিম রয়েছে। ডালডার সঙ্গে রং, ফ্লেভার ও কোকো পাউডার মিশিয়ে এই ক্রিম তৈরি হয়। আকর্ষণ বাড়াতে লাল, সবুজ, হলুদসহ নানা রঙের ক্রিম তৈরির জন্য ব্যবহার করা হয় ইন্ডাস্ট্রিয়াল কালার।
এক কর্মী স্বীকার করেন, কারখানা চালাতে মালিকের কোনো ট্রেড লাইসেন্স বা বিএসটিআইয়ের অনুমোদন ও বৈধ গ্যাস নেই।বেশ কয়েকদিন কারখানার ওপর নজর রেখে দেখতে পাওয়া যায় সকাল ১০টার কিছু পরে দুই ব্যক্তি সেখান থেকে জন্মদিনের কেক পিকআপে নিয়ে বেরিয়ে যান। সন্ধ্যার পর কয়েকটি কেকের বাক্স নিয়ে কারখানায় ফিরে আসেন তারা।
কারখানার এক কর্মচারীকে প্রশ্ন করলে স্বীকার করেন তিনি কারখানার ডেলিভারি ম্যান হিসেবে কাজ করছেন। পাশাপাশি চুক্তিভিত্তিক কর্মচারী হিসেবে খণ্ডকালীন কেক তৈরি করেন।
তার কাজ হলো প্রতিদিন দুপুরের পর বিভিন্ন দোকানে অর্ডার অনুযায়ী কেক পৌঁছে দেয়া। আর পরদিন সকালে তিন দিনের বেশি পুরোনো কেক কারখানায় ফিরিয়ে আনা।এভাবে বিভিন্ন দোকানে পাঠানো হয় আল আমিনের কারখানার কেক।
ঘটনার দিন সকালে তিনি দুই দোকান থেকে কয়েকটি পুরোনো কেক ফেরত এনেছেন।কারখানার এক কর্মী নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, দোকান থেকে ফিরিয়ে আনা বাসী কেকে আবার নতুন ক্রিম মাখিয়ে পরদিন ফের দোকানে সরবরাহ করা হয়।
তিনি বলেন, ‘পাউন্ড ১০০ টাকা দরে কেক বিক্রি করে খুব সীমিত লাভ হয়। এর মধ্যে যদি আবার কেক ফেরত আসে তাহলে ব্যবসা চলবে না। তাই আমরা পুরোনো কেকে আবার ক্রিম মাখিয়ে বিক্রি করি।’
মোগরাপাড়া চৌরাস্তার এক কনফেকশনারির মালিক বাসী কেক ফেরত দেয়া সম্পর্কে বলেন,‘কারখানার সঙ্গে আমার কনট্রাক্ট হলো বিক্রি না হলে ফেরত নিয়ে নতুন কেক দেবে। এটাই হয় সব জায়গায়।’বাসী কেকের ওপর ক্রিমের নতুন প্রলেপ দেয়া এবং কারখানায় নোংরা পরিবেশের তথ্য জানেন কি না, এমন দোকান মালিকের দায়সারা জবাব,এত কিছু আমাদের জানতে হয় না,এত কিছু জানলে ব্যবসা করা যাবে না।
সোনারগাঁও উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা (কর্মকর্তা) ডা.সাবরিনা হক জানান, অস্বাস্থ্যকর কেমিক্যাল ও নিম্নমানের উপকরণ দিয়ে তৈরি করা এসব খাবার সামগ্রী খেলে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি হতে পারে। পেট ব্যথা, আমাশা, ডায়রিয়া, শরীর দুর্বল’সহ জটিল ও কঠিন রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি থাকে।
এবিষয়ে সোনারগাঁও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রেজওয়ানুল হকের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আল- আমিন বেকারীর যদি বিএস’টিআই অনুমোদন না থাকে এবং অস্বাস্থ্যকর ও ভেজাল খাদ্য তৈরি করে বাজারে সরবরাহ করে,তাহলে ওই প্রতিষ্ঠান ও মালিকের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।