১১ জুলাই এলে আমি নড়েচড়ে বসি। একটা সময় ছিলো যখন ১১ জুলাই এ সারাদিন মাতামাতি করতাম। একটা অদ্ভুত আনন্দের আতিশয্যে আমরা নব্বই দশকের বন্ধুরা দলবেঁধে তাঁর বাসায় যেতাম। তিনি হাসতেন। কথা বলতেন। বেশ স্টাইল করে সিগারেট ধরিয়ে গালভর্তি ধোঁয়া ছাড়তেন। ধোঁয়া বেরিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর চোখে একটা অদ্ভুত শিশু সারল্য দেখতাম। ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে মুচকি হাসি হাসতেন।আমি কথা বলছি কবি আল মাহমুদ কে নিয়ে। বাংলা কবিতার পঞ্চাশের দশকের খ্যাতিমান কবি আল মাহমুদ। কবিতার মধ্যে দিয়ে ক্রমাগত সামনের দিকে এগিয়ে তিনি এমন এক কবিতার সাম্রাজ্য নির্মাণ করে গেছেন, যা তাঁর সময়ের সামিয়ানা ডিঙিয়ে মহাকালের পথে । এবং এই বিস্ময়কর অবস্থান তিনি তাঁর জীবদ্দশায় দেখে গেছেন। তাঁর কবিতার ভাষা আমাদের সময়ের ( নব্বই দশকে) অনেক তরুণ কবিতা কর্মীদের প্রভাবিত করেছিল। তাঁর সান্নিধ্য মানেই কবিতার নতুন বিষয় নিয়ে ধুন্ধুমার আড্ডা। কবিতায় ক্রেজ সৃষ্টি করেছিলেন। সোনালি কাবিন এর কবি পরবর্তীতে যত কবিতা লিখেছেন, তা তাঁর বন্ধু থেকে তরুণতম কবিতা কর্মী ও পাঠক মহল অধীর আগ্রহে পাঠ করতো। এটাই হলো কবির ক্যারিশমা। তাঁর প্রভাব এমন হয়েছিল, অনেককেই দেখেছি নামের শেষে ” মাহমুদ ” যুক্ত করেছেন। বাংলা কবিতায় তুমুল জনপ্রিয় কবি আল মাহমুদ প্রতিদিনই তাঁর অমর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে পাঠকের হৃদয়ে আলোড়ন তুলছেন, কড়া নাড়ছেন।
বগুড়া জেলা থেকে ঢাকায় ১৯৯৬ সালে প্রথমবার রওনা দেই কবি আল মাহমুদের সাক্ষাৎ পাবার আশায়।এর আগে ঢাকা শহরে প্রথম পা রাখি ১৯৮৮ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে। তিনমাস অখন্ড অবসর।কি করি। মামা থাকেন ঢাকায়। অতএব ঢাকায় গমন। ১৯৯৬ সালে আল মাহমুদ কে প্রথম দেখি। কিন্তু প্রথম আড্ডা হয় ১৯৯৮ সালে, উদ্যান লিটলম্যাগ বের করার জন্য আল মাহমুদের দুয়ারে হাজির হই লেখা নেয়ার আশায়। তিনি তরুনদের সঙ্গে আড্ডা দিতে পছন্দ করেন। তা একঘন্টার আড্ডায় বুঝে গেলাম। তিনি তরুণদের বোঝার চেষ্টা করেন, তাদের লেখা মনোযোগ সহকারে পাঠ করেন। কথা বলেন। চা খান। সিগারেট ধরিয়ে গালভর্তি ধোঁয়া ছাড়েন। কিন্তু চোখে ঝিলিক দেয় কবিতার জ্যোতি। পাঁচদিন ঢাকায় ছিলাম ১৯৯৮ সালে উদ্যানের জন্য। কিন্তু জানতাম না নিয়তি আমাকে চিরদিনের জন্য ঢাকায় টেনে আনছে পরের মাসেই চাকরিসূত্রে। তো, পাঁচদিনের প্রতিদিনই বিকেলে চলে আসতাম মোহাম্মদপুর থেকে শাহবাগে।তারপর যেতাম কবি আল মাহমুদের মগবাজারের মধুবাগ এলাকায়। উদ্দেশ্য লেখা নেয়া। তিনি গল্প করেন। চা খাওয়ান। কবিতা পাঠ করেন। নতুন কি লিখছি,জানতে চান। কিন্তু লেখা দেননা। আমিও নাছোড়বান্দা লেগে রইলাম।লেখা নিয়েই যাবো। পাঁচদিন পর বুঝলাম, লেখা বের করা অসম্ভব। ফিরে গেলাম বগুড়ায়। উদ্যান লিটলম্যাগ বের হলো ১৯৯৮ সালে। কবি আল মাহমুদ ভাই এর লেখা ছাড়াই। উদ্যান বের হওয়ার পর চাকরি সূত্রে ঢাকা এলাম। দিনকে দিন আল মাহমুদের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি হতে লাগলো। কবিতা নিয়ে বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় আড্ডা হতে লাগলো। বাংলা কবিতা, আন্তর্জাতিক কবিতা নিয়ে আল মাহমুদ যখন কথা বলতেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো আমরা শুনতাম। তিনি বলতেন, “কবিতা একটা জীবন চায়, একটা জীবন ব্যয় করতে হয় কবিতার জন্য। তবেই কবিতা ধরা দেয়”..। ধীরে ধীরে কবি আল মাহমুদ এর কবিতার গভীরে অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে খুঁজতে লাগলাম আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও কবিতার পথ।
আল মাহমুদ ভাইকে নিয়ে পড়তে পড়তে আল মাহমুদের কবিতা নিয়ে বেশ কিছু প্রবন্ধ নব্বই দশকের শেষ ভাগে জাতীয় দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক জনকণ্ঠ, দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকা ও কয়েকটি লিটলম্যাগে প্রকাশিত হয়। আমার সবগুলো লেখা আল মাহমুদ পড়েছেন। একদিন শাহবাগে আজিজ মার্কেটে দেখা হলো। কবির সঙ্গে সময়ের একঝাঁক তরুণ কবিদল।
আমাকে দেখেই বললেন, ” তাওফিক( আমাকে এভাবেই সম্বোধন করতেন মাহমুদ ভাই), তোমার প্রবন্ধগুলো নিয়ে একটা গ্রন্থ করো।তোমার গদ্যের হাত খুব ভালো। এগুলো একসময় দেখবে দরকারী হয়ে গেছে “। কথাটা আমার হৃদয় ছুঁয়ে গেলো। কবি জাকির ইবনে সোলায়মান সেইদিন আল মাহমুদ ভাই এর সঙ্গে ছিলেন। তাঁর স্বচ্ছন্দ্য নামে একটা প্রকাশনী ছিলো। তিনি হঠাৎ বললেন, বন্ধুর এই প্রবন্ধ গ্রন্থ আমার প্রকাশনী থেকে প্রকাশ করবো। রাজি হয়ে গেলাম। নব্বই দশকের কবি জাকির ইবনে সোলায়মান প্রকাশ করলেন, আমার ” আল মাহমুদ ও অন্যান্য ” প্রবন্ধ গ্রন্থ (২০০৩)।
এই প্রবন্ধগ্রন্থ বের হওয়ার পর প্রথম কপি কবি আল মাহমুদ কে দেয়ার জন্য তাঁর বাসায় গেলাম। তিনি তখন মধুবাগের বাসা ছেড়ে গুলশান এক এ পোস্ট অফিস গলিতে বিশাল অট্টালিকায় উঠেছেন। কবিকে আমার প্রবন্ধ গ্রন্থ দেয়ার পর তিনি ভীষণ খুশি হলেন। মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করলেন। লিখতে বললেন। উজাড় করে নিজেকে।
আমি তখন একটি জাতীয় ম্যাগাজিনে নির্বাহীর দায়িত্বে। ঈদ সংখ্যার জন্য উপন্যাস লাগবে আমার। মাহমুদ ভাই কে বললাম। তিনি রয়ালিটি চাইলেন। আমি রাজি হলাম। আমি নিজে মাহমুদ ভাই এর ডিকটেশন নিয়েছি। এরপর মাহমুদ ভাই এর প্যারিস ভ্রমণ নিয়ে ভ্রমণ গদ্য আমি ছেপেছি ধারাবাহিকভাবে একবছর ওই ম্যগাজিনে। কবি আল মাহমুদ ভাই এর সঙ্গে অসংখ্য আড্ডা একবারে মাথার চারপাশে এসে গিজগিজ করছে। সব লেখা এ মুহূর্তে সম্ভব না। দৈনিক বাংলার মোড়ে পঞ্চাশের আরেক কবি ফজল শাহাবুদ্দীন ভাইয়ের অফিসেও বেশ আড্ডাময় স্মৃতি আছে। ডঃ আলাউদ্দিন আল আজাদ সহ, কবি মাহবুব হাসান, কবি আল মুজাহিদী, কবি ত্রিদিব দস্তিদার, কবি শাহীন রেজা, কবি শান্তা মারিয়া, কবি শাকিল রিয়াজ, কবি শাহীন রিজভী, কবি জামালউদ্দীন বারীসহ আরো অনেক কবির সঙ্গে আড্ডার সেই দিনগুলি মানস পর্দায় উপস্থিত। এমন একটি আড্ডায় কবি আল মাহমুদ বলেছিলেন একদিন হঠাৎ আমাকে বললেন, ” একজন কবি কে চিরটাকাল একাই পথ চলতে হয়। কবির কোনো বন্ধু থাকেনা। প্রকৃত কবির পথ খুবই বিপদসংকুল। কবিকে নিজের রাস্তা নিজেকেই চিনে নিয়ে এগোতে হয়”।
আজ এই লেখায় আল মাহমুদের কবিতা নিয়ে কিছু লিখবো বা। সেটা অন্য গদ্যে লিখবো। আল মাহমুদ বাংলা কবিতার এক বিস্ময়কর প্রতিভা। শেষ পর্যন্ত একজন কবির টিকে থাকে কবিতা। কবিতার মধ্যে দিয়ে তিনি পাঠকের হৃদয়ের দরোজায় কড়া নাড়েন। যে কবি যত প্রতিভাবান তাঁর কবিতা ততই পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে অলিন্দে অলিন্দে পৌঁছে শিহরণ জাগায়।
শুভ জন্মদিন কবি আল মাহমুদ ভাই। ৮৭তম জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধা।
“সোনালি কাবিন” কবিতার কয়েকটি উদ্ধৃতি দিয়ে লেখার সমাপ্তি টানছিঃ
“শ্রমিক সাম্যের মন্ত্রে কিরাতের উঠিয়েছে হাত হিয়েন সাঙের দেশে শান্তি নামে দেখো প্রিয়তমা,
এশিয়ায় যারা আনে কর্মজীবী সাম্যের দাওয়াত
তাঁদের পোশাকে এসো এঁটে দিই বীরের তকোমা”
#######
“ক্ষুধার্ত নদীর মতো তীব্র দুটি জলের আওয়াজ
তুলে মিশে যাই চলো আকর্ষিত উপত্যকায়
চরের মাটির মতো খুলে দাও শরীরের ভাঁজ
উগোল মাছের মাংস তৃপ্ত হোক তোমার কাদায়”
#####
“বধূবরণের নামে দাঁড়িয়েছে মহামাতৃকূল
গাঙের ঢেউয়ের মতো বলো কন্যা কবুল,কবুল।”
( সোনালি কাবিন)