১৫ ফেব্রুয়ারী পঞ্চাশ দশকের গুরুত্বপূর্ণ কবি আল মাহমুদের অনন্তলোকে ফিরে যাবার দিন (১১জুলাই ১৯৩৬- ১৫ ফেব্রুয়ারী ২০১৯)। বিনম্র শ্রদ্ধা এই মহৎ কবির জন্য।
দূরত্বের সৌন্দর্য এবং সৌন্দর্যের দূরত্ব
তৌফিক জহুর
১.১
“The more important Poets are those Who free themselves from the restraints of Poetic diction and bring Poetry back into realtion with living Speech”.. (Reading and Discrimination : Denys Thompson)।
প্রচলিত কাব্যিক ভাষার বন্ধন থেকে মুক্ত করে কবিতাকে প্রাত্যহিক জীবনের জীবন্ত ভাষার সঙ্গে সংযুক্ত করে তুলতে সচেষ্ট কবিই বিশেষ প্রভাব বিস্তারকারী। তিনি হয়ে ওঠেন দূরগামী। তাঁর কবিতা কাল পেরিয়ে মহাকালে উত্তীর্ণ হয়ে যায়। একজন কবির সব কবিতাই পাঠকের হৃদয়ে চিরকালের আসন গেড়ে বসে থাকবে, তা নয়। অসংখ্য কবিতার মধ্যে থেকে কয়েকটি বা একশটি কবিতা কিংবা একটি কবিতা তাঁকে কবিতার সিংহাসনে চিরকাল বসিয়ে রাখে। কবিতার শক্তি এখানেই। ১৯২২ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে লেখা কাজী নজরুল ইসলামের অমর সৃষ্টি ‘ বিদ্রোহী’কবিতা শতবছর পরও সমান জনপ্রিয় ও সময়োপযোগী। কারণ, কবিতাটি সব কালের সব সময়ের জন্য দরকারী একটি কবিতা। একজন পাঠককে প্রস্তুতি নিয়ে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার অন্দরমহলে প্রবেশ করতে হয়না। যে কোনো সময়ে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার সদর ফটকে ঠকঠক শব্দে নক করে প্রবেশ করা যায় এবং এর রস আস্বাদন করে উজ্জীবিত হওয়া যায়। এটি একটি জীবন্ত কবিতা। এর শক্তি অসীম। আধুনিক বাংলা কবিতার প্রাণপুরুষ জীবনানন্দ দাশ। তাঁরও হাতে গোণা কয়েকটি কবিতা পাঠকের হৃদয়ে চিরকালের আসন গেড়ে বসে আছে। কারণ ওই যে শুরুতেই ডেনিস থম্পসনের উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য। জগতের শৃঙ্খলা ডিঙিয়ে নতুন টেকনিকে একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে ক্রমাগত সামনের দিকে এগিয়ে গেছেন কবি জীবনানন্দ দাশ। ‘ রূপসী বাংলা ‘, ‘ আট বছর আগের একদিন’ আমাদের স্থির করে চোখ। আমরা বিস্মিত এর রূপকল্পে, চিত্রকল্পে, বর্ণনার ঢঙে আমরা ঘোরের মধ্যে চলে যাই। ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতাটি পড়তে পড়তে চিত্রশিল্পী গঁগ্যার জীবনকাহিনীর অথবা সেই কাহিনী অবলম্বনে সমারসেট মমের ‘ The Moon and Six Pence’..উপন্যাসের নায়কের কথা আমাদের মনে পড়ে। এই আলোকে কবিতাটি অন্য এক ব্যঞ্জনা লাভ করে। এ মৃত্যু যেন মৃত্যু নয়, চারিপাশের জড়তার বিরুদ্ধে সংবেদনশীল আত্মার বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহের জন্যই কবিতাটির আবেদন এমন। সব সময়ই পাঠকের হৃদয়ে আলোড়ন তোলে, জায়গা করে নেয়। জসীমউদ্দিন কে পল্লীকবির তকমা লাগিয়ে রাখা হয়েছে। কারণ, তাঁর কবিতার মধ্যে মাটির গন্ধ, শস্যের সোঁদা গন্ধ অনুভূত হয়। চিত্রায়নে এমন দক্ষতার ছাপ রেখেছেন, তাঁর সময় থেকে আজ পর্যন্ত তাঁর কবিতাগুলো ব্যাপকভাবে পাঠ করা হয় এবং আবৃত্তি শিল্পীদের পছন্দের তালিকায় চল্লিশ দশকের গুরুত্বপূর্ণ কবি জসীমউদ্দিনের কবিতা সবসময়ই অগ্রগামী। তাঁর ‘কবর’ কবিতাটি পাঠ করেনি বাংলা ভাষায় এমন পাঠক পাওয়া সম্ভব নয়। ‘কবর’ কবিতার চিত্রকল্প ও বুনন এতেটাই হৃদয়কাড়া যা পঠকের মনে বহু বছর ধরে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে আছে। গ্রাম বাংলার দৃশ্যায়ন চোখের সামনে ভেসে ওঠে। নববধূকে দেখার যে চিত্র কবি এখানে এঁকেছেন তা গ্রাম বাংলার কাল্পনিক কোনো ছবি নয়, একদম ঠিকঠাক ও যুতসই। যে পাঠক যখনই ‘ কবর’ কবিতা পাঠ করে তখনই তাঁর চোখের সামনে অকৃত্রিম দৃশ্য ভেসে ওঠে। ষাট দশকের গুরুত্বপূর্ণ কবি ও গবেষক আবদুল মান্নান সৈয়দ ‘ জসীমউদ্দিনের কবিতা’.. প্রবন্ধে জানাচ্ছেন, ” জসীমউদ্দীনের কাব্যগ্রন্থগিলো সংস্করণের পর সংস্করণ হয়েছে (আমার হাতে রয়েছে জসীম উদদীনের ” নকশিকাঁথার মাঠ,চতুর্দশ সংস্করণ ১৯৮৬; “সোজন বাদিয়ার ঘাট চতুর্দশ সংস্করণ ১৯৮৬”, প্রথম বইটি দশহাজার কপিও ছাপা হয়েছে, দ্বিতীয় বইটি পাঁচ হাজার) আধুনিককালে নজরুল ব্যতীত আর কোনো কবির বই এরকম অগাধ লোকপ্রিয়তা পায়নি।এই লোকপ্রিয়তার কারণ কি? কারণ মনে হয় জসীমউদদীনের কথকতার শক্তি “… ( করতলে মহাদেশ, পৃষ্ঠা ৯৬)। আবদুল মান্নান সৈয়দ এই প্রবন্ধ লিখেছেন কমপক্ষে চল্লিশ বছর আগে। সে সময় জসীমউদদীনের দুটি কবিতার কিতাব পনের হাজার কপি বিক্রি হয়েছে। আধুনিককালে এ সময় একজন কবির কবিতার কিতাব একশ কপি বিক্রি হওয়া দুরূহ। নানান কায়দায় এখন বই বিক্রি করা হয়। কিন্তু জসীমউদদীনের কবিতার কিতাব বিক্রি করতে কায়দা লাগেনা, কবিত্ব শক্তির প্রভাব এতোটাই প্রবল, আজো মানুষ জসীমউদদীন দ্বারা আক্রান্ত। যেমন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ দাশ দ্বারা আক্রান্ত।
১.২
জসীমউদদীনের পর যাঁর কবিতা আমাদের প্রকৃত অর্থে আধুনিকতা ও লোকজতা এবং গ্রাম বাংলার চাদর জড়িয়ে হাজির হয়, তিনি পঞ্চাশের দশকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কবি আল মাহমুদ। আল মাহমুদ আধুনিকতাকে গাছের পাতার মতো ধারণ করেননি, আধুনিকতার শিকড় প্রোথিত ও সঞ্চারিত করেছেন তাঁর কবিতার শিরায় শিরায়। তাঁর কবিতার শিখর পঞ্চাশ দশকে থেকে শুরু হয়ে বর্তমান কাল পর্যন্ত সমীরিত। আমরা আল মাহমুদের কবিতার আকাশে প্রথমে খুঁজে পাই আত্মনিমজ্জিত ও আত্মজগতের এক বাসিন্দা হিসেবে। সময় যতই এগিয়েছে আল মাহমুদ ক্রমশ নিজেকেই নিজে ছাড়িয়ে গেছেন। আমি থেকে পৌঁছে গেছেন আমরায়। নারী, যৌনতা, শরীরী, গার্হস্থ্য জীবন, প্রকৃতি, দেশ, কাল,ঐতিহ্য এবং প্রেম আল মাহমুদের কবিতার সাম্রাজ্যে সাজানো একটার পর একটা পদাতিক বাহিনী যেন। সুসজ্জিত, সৌন্দর্যের যাদু কিন্তু বাস্তবের সঙ্গে দারুণ সাজুয্য বজায় রেখেছেন। দেশজতায়, দেশপ্রেমে আল মাহমুদের কবিতার আত্মপরিধি সম্প্রসারিত হয়েছে। আল মাহমুদের সমগ্র কাব্যজীবনকে আমরা কয়েকটি ভাগে বলতেই পারি আজকে। তিনি প্রথম পর্যায়ে ব্যক্তিগত, দ্বিতীয় পর্যায়ে সামাজিক, তৃতীয় পর্যায়ে শিকড়সন্ধানী। ব্যক্তিগত আল মাহমুদ আত্মতা থেকে উত্তরকালে মুক্তি পেয়েছিলেন সেখানেও ছিলো দুটি ধাপ। প্রথমত সমাজচেতনা দ্বিতীয়ত ইতিহাস ও কল্প ইতিহাস চেতনা। “লোক লোকান্তর “, ” কালের কলস “, ” মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো” আল মাহমুদ নিজেকে বহুবর্ণে, বহুরূপে নিজের কবিতার জাত সমগ্র বাংলা ভাষাভাষী পৃথিবীর মানুষকে চেনালেন। ‘ লোক লোকান্তরে’র কবি ক্রমশ কালের কলস ভাসালেন।দেশপ্রেম, স্বজাতিপ্রেম, কাল ও সমাজচেতনা আল মাহমুদকে ক্রমশ নিবিষ্ট করে সময়ের বিশেষ পটে। মূলত কালের কলস থেকে অর্থাৎ দ্বিতীয় পর্যায়েই এর সূচনা হয়। তীব্র সমাজচেতনা, স্বদেশী বোধ কবি আল মাহমুদ কে যখন প্রবলভাবে ঘিরে ফেলেছে তখনও তিনি তাকে উপস্থিত ও উচ্চারণ করেছেন কবিতার পোশাকেই। বাংলাদেশ তখন তাঁর কবিতায় উপুর্যুপরি উঠে আসছে তাঁর নির্মিত সবুজ পোশাক প’রেই। আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করি, আল মাহমুদের পরবর্তী উত্তরণ যা ইতিহাস, ঐতিহ্য, দেশকাল, দর্শন লেপ্টে দিয়ে নিজেকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেলেন। কথা বলছি তাঁর অমর সৃষ্টি ” সোনালি কাবিন” কাব্য গ্রন্থ নিয়ে। যেখানে কিছু প্রাচীন শব্দ ব্যবহার করেছেন আল মাহমুদ। সোনালি কাবিনে ১৪ টি সনেট গুচ্ছ রয়েছে। নিবিড় চর্চায় বোঝা যায় আল মাহমুদ প্রবলভাবে দৃষ্টিইন্দ্রিয় ও ঘ্রাণেন্দ্রিয় কবি। সহজ, সরল, অনায়াস, মোচড়হীন কবিত্বশক্তি আধুনিক বাংলা কবিতার সাম্রাজ্যে খুব কম জন্মেছেন। দান্তে যেমন স্বর্গ যাত্রার পথে নরকে প্রবেশ করেছিলেন, এলিয়ট যেমন নতুন বিশ্বাসের সঞ্জীবনী ধারায় পূর্ণতর মানবতার পুনরুজ্জীবিত করবার আশা নিয়ে ‘পোড়োজমিতে’ প্রবেশ করলেন এবং ব্যক্তিসত্তার চূর্ণ বিচূর্ণ পরমাণু নিয়ে অতীত বর্তমানের ঐতিহ্য সমন্বয় ক’রে আবার নতুন সত্তা রচনা করা যায় কিনা এই ছিল তাঁর অন্বিষ্ট তেমনিভাবে বলা যায় আল মাহমুদও বাংলা কবিতার জগতে ” সেনালি কাবিন” সনেট গুচ্ছ দিয়ে ব্যক্তির সঙ্গে জাতির, জাতির সঙ্গে পরিবেশের, পরিবেশের সঙ্গে দৃষ্টিভঙির সাযুজ্য, মানবতার সঙ্গে দর্শন, চিন্তার গভীরতায় ঐতিহ্যের একটা লাল ঝান্ডা যা বিশ্বাসের বাতাসে পতপত করে উড়বে এমন জ্ঞান যুক্ত করেছেন। সোনালি কাবিন সনেট গুচ্ছে গম্ভীর ও তরল রসের একত্রে পরিবেশনা আছে। ফলে কবিতাটির দ্যোতনা বৃদ্ধি পেয়েছে। কবিতাকে শুধু কৃত্রিম উপমার চাদরে না জড়িয়ে জীবন্ত সমাজের সঙ্গে যুক্ত করেছেন। বাংলা কবিতার প্রধান উপজীব্য ( মাইকেল মধুসূদন দত্ত থেকে শুরু করলে দেখা যায়) জাতীয়তাবোধ, রোমান্টিকতা, স্বপ্নময়তা, সুন্দরে বিশ্বাস, পল্লী বাংলার অনাড়ম্বর, অকৃত্রিম সারল্য ও শুচিতার প্রতি আকর্ষণ, প্রেমের মাধুর্য, কাম, নিষ্ঠায় আস্থাবোধ। সোনালি কাবিন সনেট গুচ্ছে এর সবগুলো উপাদান বিদ্যমান। আল মাহমুদ আত্মসচেতনতায় বলীয়ান হয়ে মননের বৈচিত্র্যতা, নৈব্যক্তিকতার আদর্শ ও ঐতিহ্যের দিকে মনোযোগী হওয়ার পরও প্রেম, ধর্ম, মৃত্যু, সৃষ্টিকর্তা, কাল প্রভৃতি সম্বন্ধে নতুন করে ভেবেছেন। ফলে তাঁর কবিতা নতুন আঙ্গিকে নতুন দৃষ্টিভঙিতে পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয়েছে।
“বধূ বরণের নামে দাঁড়িয়েছে মহামাতৃকূল
গাঙের ঢেউয়ের মতো বলো কন্যা কবুল কবুল”
( সোনালি কাবিন)
দূরত্বের সৌন্দর্য, সৌন্দর্যের দূরত্ব….. যেখান থেকেই দেখি না কেনো, বাংলা ভাষা ও কবিতায় আল মাহমুদ অপরিহার্য নাম।
১৬/০২/২০২৪, শুক্রবার, মোহাম্মদপুর, ঢাকা