দ্বাদশ জাতীয় সংসদের ঝিনাইদহ-১ আসনের সংসদ সদস্য মো. আব্দুল হাইয়ের মৃত্যুতে আজ জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে শোক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে।
এছাড়া, দশম সংসদে চাঁদপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য ড. মোহাম্মদ শামছুল হক ভূঁইয়া, একাদশ সংসদে কুমিল¬া-৫ আসনের সংসদ সদস্য আবুল হাসেম খান, নবম ও দশম সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য পিনু খান, ৫ম, ৬ষ্ঠ ও ৮ম সংসদের সুনামগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য নজির হোসেন এবং দ্বিতীয় সংসদে রংপুর-৩ ও ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদে গাইবান্ধা-৩ আসনের সংসদ সদস্য মোখলেছুর রহমানের মৃত্যুতে শোক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এ শোক প্রস্তাব সংসদে উত্থাপন করেন। শোক প্রস্তাবে সংসদ সদস্যবৃন্দের মৃত্যুতে মহান জাতীয় সংসদ থেকে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করা হয়।
মো. আব্দুল হাই ১৯৫২ সালের ১ মে ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলার মহম্মদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং ২০২৪ সালের ১৬ মার্চ থাইল্যান্ডের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন (ইন্না লিল¬াহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৭১ বছর ১০ মাস ১৫ দিন।
মো. আব্দুল হাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি ১৯৬৪ সালে বসন্তপুর হাই স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যোগ দেন এবং ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত ঝিনাইদহ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি এবং কে.সি. কলেজ ছাত্র সংসদের সভাপতি ছিলেন। তিনি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি হিসেবে ঝিনাইদহে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা প্রথম উত্তোলন করেন। মো. আব্দুল হাই ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি সক্রিয় গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে বীরত্বের স্বাক্ষর রাখেন। তিনি ১৯৭২-১৯৭৩ পর্যন্ত জেলা যুবলীগের আহবায়ক ছিলেন। ১৯৭৩ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত তিনি জেলা যুবলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৯৮ থেকে ২০০২ পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০২ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের আহবায়ক এবং পরবর্তীতে তিনি সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি অষ্টম, নবম, দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদে পর পর পাঁচবার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি অষ্টম জাতীয় সংসদে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য, নবম জাতীয় সংসদে তিনি মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী, ভূমি মন্ত্রণালয় ও বেসরকারি সদস্যদের বিল ও সিদ্ধান্ত প্রস্তাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি দশম জাতীয় সংসদে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি এবং নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি একাদশ জাতীয় সংসদে লাইব্রেরী কমিটি এবং খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি একই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। রাজনীতির পাশাপাশি তিনি নিজ এলাকায় বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক কর্মকান্ডের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন।
সংসদে উত্থাপিত শোক প্রস্তাবে বলা হয়, ‘এ সংসদ প্রস্তাব করছে যে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদের ৮১ ঝিনাইদহ-১ আসনের সংসদ সদস্য মো. আব্দুল হাই এর মৃত্যুতে দেশ একজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও নিবেদিতপ্রাণ সমাজ সেবককে হারালো। এ সংসদ তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক ও দু.খ প্রকাশ, রুহের মাগফিরাত কামনা এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি আন্তরিক সহমর্মিতা প্রকাশ করছে।’
সংসদের রেওয়াজ অনুযায়ি সংসদ সদস্য মো. আব্দুল হাই -এর স্মরণে সংসদে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নেন।
শোক প্রস্তাবে অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী তার মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেন এবং তিনি তার রুহের মাগফেরাত কামনা করেন। তিনি শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
অন্যান্যের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন রেলপথ মন্ত্রী জিল্লুল হাকিম, সরকারি দলের সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক, এস এম কামাল হোসেন, মো. তৌহিদুজ্জামান, কাজী নাবিল আহমেদ ও স্বতন্ত্র সদস্য নাসের শাহরিয়ার জাহিদী।
শোক প্রস্তাবে স্পিকার বলেন, আমরা ইতোমধ্যে পাঁচজন সাবেক সংসদ সদস্যকে হারিয়েছি। তারা হলেন- দশম সংসদে চাঁদপুর-৪ আসনে সংসদ সদস্য ড. মোহাম্মদ শামছুল হক ভূঁইয়া, একাদশ সংসদে কুমিল¬া-৫ আসনের সংসদ সদস্য আবুল হাসেম খান, নবম ও দশম সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য পিনু খান, ৫ম, ৬ষ্ঠ ও ৮ম সংসদের সুনামগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য নজির হোসেন এবং দ্বিতীয় সংসদে রংপুর-৩ ও ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদে গাইবান্ধা-৩ আসনের সংসদ সদস্য মোখলেছুর রহমান। তাদের মৃত্যুতে মহান জাতীয় সংসদ গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করছে।
স্পিকার বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ভাষা সৈনিক, একুশে পদক প্রাপ্ত ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, প্রবীণ সাংবাদিক ও প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা ইহসানুল করিম, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য, একুশে পদকপ্রাপ্ত শিক্ষাবিদ ড. প্রণব কুমার বড়–য়া, বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার অন্যতম নকশাকার, জাসদ নেতা বীরমুক্তিযোদ্ধা শিব নারায়ণ দাস, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, স্বাধীনতা পদক প্রাপ্ত সাবেক সংসদ সদস্য মরহুম এম আব্দুর রহিমের সহধর্মিণী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম এমপি’র মাতা নাজমা রহিম, বরগুনা-১ আসনের সংসদ সদস্য গোলাম সরোয়ার টুকুর বাবা আব্দুস সোবহান হাওলাদার, রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী ও সংগীতের গুরু সাদি মহম্মদ, জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী, ‘চাইম’ ব্যান্ডের ভোকালিস্ট খালিদ, ভারতীয় গজল সংগীতের প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব পঙ্কজ উদাস, বাংলার কৃষকদের অধিকার আদায়ের ঐতিহাসিক টঙ্ক আন্দোলনের নেত্রী কুমুদিনী হাজং, প্রখ্যাত অভিনেতা আহমেদ রেজা রুবেল এর মৃত্যুতে মহান সংসদ গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করছে।
স্পিকার বলেন, মস্কোর ক্রোকাস সিটি হলে সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলায় হতাহতের ঘটনা, গাজা উপত্যকায় আবাসিক ভবনে ইসরায়েলি বিমান হামলায় হতাহতের ঘটনা এবং দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে দুর্ঘটনায় হতাহতদের স্মরণে মহান জাতীয় সংসদ গভীর শোক প্রকাশ, সকল বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জ্ঞাপন করছে।
শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনার পর সর্বসম্মতিক্রমে তা গৃহিত হয়। পরে মৃত্যুবরণকারীদের সম্মানে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন ও তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে মোনাজাত করা হয়। মোনাজাত পরিচালনা করেন স্বতন্ত্র সদস্য মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরী।
এরপর সংসদের নিয়ম অনুযায়ী বিদ্যমান সংসদের সদস্যের মৃত্যুতে দিনের অন্যসব কার্যসূচি স্থগিত করে সংসদের বৈঠক মুলতবি করা হয়।