(ঢাবি) অধিভুক্তি নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার মধ্যে ঢাবি শিক্ষার্থীদের একাংশ ও সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা এখন মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছেন। সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা চাইছেন অধিভুক্তি-পরবর্তী শিক্ষার্থীরা সেশনজটসহ যে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে তা যেন দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়। আর ঢাবির শিক্ষার্থীরা চাইছেন সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিল হোক। কারণ হিসেবে তারা দাবি করেন সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা ঢাবির জন্য বেমানান এবং তারা ঢাবির জন্য বোঝা হয়ে এসেছে। গত জুলাই মাসে বেশ কয়েকবার বিক্ষোভ কর্মসূচি দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের দরজায় কয়েক দফা তালাও ঝুলিয়েছেন। ঢাবি শিক্ষার্থীদের এমন হার্ডলাইন দেখে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরাও এখন বিগড়ে বসেছেন। তারাসোমবার সংবাদ সম্মেলন ডেকে ঘোষণা দিয়েছেন সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত হলে রাজধানী ঢাকাকে অচল করে দেওয়া হবে। প্রয়োজনে তারা সেশনজটের দুই বছরের হিসাব মাঠে দাঁড়িয়ে নেবেন। বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন এমন অনেকেই বলছেন, এ কেমন বিরোধ? অধিভুক্তি নিয়ে এ কেমন বিরোধ সৃষ্ট সংকট পুরোটাই প্রশাসনিক। জোর করে ধরে নিয়ে এসে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের ঢাবির অধিভুক্ত করা হলো। এরপর তাদের শিক্ষাজীবন ফেলে দেওয়া হলো অনিশ্চয়তার মুখে। এ নিয়ে তারা কথা বলছেন, আন্দোলন করছেন।এ অবস্থায় সংকটের সমাধান না করে তাদের ঢাবির শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি দাঁড় করানো হচ্ছে কেন? ঢাবির শিক্ষার্থীরাই বা কোন যুক্তিতে সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিল চাইছেন- তা অনেকের বোধগম্য হচ্ছে না।সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাবির নিজস্ব তত্ত্বাবধানে ১০টি ইনস্টিটিউটসহ অধিভুক্ত সরকারি-বেসরকারি অর্ধশতকেরও বেশি মেডিকেল কলেজ, ১০টি ডেন্টাল কলেজ, ১২টি নার্সিং কলেজ, ৩টি হোমিওপ্যাথী, ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক কলেজ, আটটি মেডিকেল ইনস্টিটিউট, ১০টি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট, চারটি গার্হস্থ্য কলেজ রয়েছে। এতগুলো প্রতিষ্ঠান ঢাবির বোঝা হয়ে আসেনি তাহলে সাত কলেজ কেন ঢাবির জন্য বোঝা হয়ে আসবে? ঢাবির আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা শুধু সাত কলেজের অধিভুক্তিই বা বাতিল কেন চাইছেন? এখানে অন্য কোনো ‘খেলা’ আছে কি না সে সন্দেহও করছেন অনেকে।গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাত কলেজ ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজকে। ঢাবি অধিভুক্ত হওয়ার ৫ মাসের মাথায় পরীক্ষা ও পরীক্ষার ফল প্রকাশ সংক্রান্ত নানা জটিলতা সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে সেশনজট লেগে যায় কলেজগুলোতে।এ পরিস্থিতিতে ২০১৭ সালের জুলাইয়ে শাহবাগ অবরোধ করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন ৭ কলেজের শিক্ষার্থীরা। সে সময় তারা ঢাবি অধিভুক্ত কলেজগুলো নিয়ে নীতিমালা প্রণয়ন ও প্রকাশসহ ২০১৪-২০১৫ শিক্ষাবর্ষের মাস্টার্স শেষ পর্বের ভর্তি কার্যক্রম শেষ করা, ডিগ্রির আটকে থাকা সব বর্ষের পরীক্ষা দ্রুত শেষ করা, অধিভুক্ত কলেজগুলোর তথ্য সংবলিত একটি ওয়েবসাইট তৈরি ও শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং সেশনজট নিরসনে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি তুলেন। এসব দাবি নিয়ে শিক্ষার্থীদের শাহবাগ অবরোধ বানচাল করতে পুলিশ নির্বিচারে লাঠিচার্জ এবং টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। ২০ জুলাই পুলিশের ছোড়া কাঁদানে গ্যাসের শেলে চোখ হারান তিতুমীর কলেজের ছাত্র সিদ্দিকুর রহমান। মামলা দেওয়া হয় ১২০০ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে।এ নিয়ে সারা দেশে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার ও পুলিশ প্রশাসন। পুলিশের বেপরোয়া আচরণের কারণে ধ্বংস হয়ে যায় সিদ্দিকুরের জীবন। ৭ কলেজের শিক্ষার্থীরা আশা করেছিলেন, সিদ্দিকুরের এ ঘটনার মধ্য দিয়ে অন্তত সরকার ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চোখ খুলবে। কিন্তু ঢাবি অধিভুক্তির এক বছরেও দুই লাখ শিক্ষার্থীর শিক্ষা-সংকট নিরসনে উদ্যোগ নেয়নি কেউ।পরীক্ষার ফলাফলে সৃষ্ট বিপর্যয়কে কেন্দ্র করে গত কয়েক মাস ধরে দফায় দফায় আন্দোলনে নামেন ৭ কলেজের শিক্ষার্থীরা। পরীক্ষা শেষ হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে ত্রুটিমুক্ত ফলাফল প্রকাশ, ডিগ্রি, অনার্স, মাস্টার্স সব বর্ষের ফলাফল গণহারে অকৃতকার্য হওয়ার কারণ প্রকাশসহ খাতার পুনর্মূল্যায়ন করা; সাত কলেজ পরিচালনার জন্য স্বতন্ত্র প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ; প্রতি মাসে প্রত্যেকটা বিভাগে প্রতি কলেজে দুদিন করে মোট ১৪ দিন ঢাবির শিক্ষকদের ক্লাস নেওয়া; সেশনজট নিরসনের লক্ষ্যে একাডেমিক ক্যালেন্ডার প্রকাশসহ ক্রাশ প্রোগ্রাম চালু করার দাবি জানান তারা। এসব দাবি মেনে নিয়ে ঢাবি উপাচার্য আখতারুজ্জামান বেশ কিছু সমস্যা দ্রুত সমাধান এবং কয়েকটি সমস্যা সমাধানের জন্য কয়েক মাস সময় চেয়ে নেন। উপাচার্যের আশ্বাসে আন্দোলন স্থগিতও করে দেন সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা।এসব আন্দোলরে মধ্যেই হঠাৎ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একাংশ ঢাবির অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের ঢাবিতে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন এবং তাদের অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে মাঠে নামেন। তারা গত ১৩ জানুয়ারি থেকে বিক্ষোভ, অবস্থান, ক্লাস বর্জন, প্রক্টর ও উপাচার্য অফিস ঘেরাওসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছেন। শিক্ষার্থীদের এ দাবির পর ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান আন্দোলনকারীদের আশ্বস্ত করলেন, সাত কলেজের সব কার্যক্রম তাদের নিজস্ব ক্যাম্পাসে হবে, তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বলে পরিচিত হবেন না। যদিও এ আশ্বাসে ক্ষান্ত হননি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে ফের তারা মাঠে নামেন।২১ জুলাই থেকে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক ভবনের মূল ফটকে তালা লাগিয়ে বিক্ষোভ করেন। তাতে বন্ধ হয়ে যায় ক্লাস ও ক্লাস পরীক্ষা। টানা ছয় দিন বিক্ষোভের পর গত ২৫ জুলাই প্রশাসনের উদ্যোগে আশ্বস্ত হয়ে তারা ক্লাসে ফেরে। ক্লাসে ফেরার আগে আন্দোলনকারীদের মুখপাত্র ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী শাকিল মিয়া এ বলেন, আমরা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন কর্মসূচি থেকে সরে আসলেও আমাদের অন্যান্য কর্মসূচি চলমান থাকবে। প্রশাসনের দেওয়া আশ্বাসকে পর্যবেক্ষণে রেখে আমরা আমাদের পরবর্তী কর্মসূচি নির্ধারণ করব।’ এ দাবিতে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দেওয়ার ঘোষণাও দেন তিনি।সাত কলেজের অধিভুক্তি নিয়ে উদ্ভূত সমস্যা সমাধানে কার্যকর সুপারিশ দিতে বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-উপাচার্য (প্রশাসন) মুহাম্মদ সামাদকে আহ্বায়ক করে গঠিত কমিটিকে ১১ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে। ১০ কার্যদিবসের মধ্যে তাদের সুপারিশ দেওয়ার কথা।এর মধ্যে ঈদের ছুটির আগেই সাত কলেজের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তি বাতিল হলে রাজধানী অচল করে দেওয়া হবে। সোমবার ঢাকা কলেজে এক সংবাদ সম্মেলনে পাঁচদফা আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক আবুবকর বলেন, ‘যদি কোনো কুচক্রী মহলের প্রভাবে সাত কলেজ নিয়ে কোনো প্রকার অবৈজ্ঞানিক বা হঠকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তাহলে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা মাঠে নেমে প্রয়োজনে গণআন্দোলনের ডাক দিয়ে সদরঘাট থেকে মহাখালী পর্যন্ত অবরোধ করে ঢাকা অচল করে দেব।’উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গত ২৪ জুলাই অবশ্য সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানিয়েছিলেন, লন্ডন সফররত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত কলেজের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন।