একবুক স্বপ্ন আর পরিবারের মাথায় পাহাড়সম দেনার বোঝা চাপিয়েই অধিকাংশ যুবক বিদেশে পাড়ি জমায়। সংসারের হাল ধরার শপথ নেয়া মানুষটা বিদেশ যাবার পর অসচ্ছল ও ঋনগ্রস্থ পরিবারটি আশার আলো দেখতে থাকে। একদিন সুখ নামের পাখিটা ধরা দিবে তাদের খাচায়। কিন্তু বিদেশে এসে বিভিন্ন বিপথগামী মানুষের পাল্লায় পড়ে সেই মানুষটি যখন বদলে যায়, নিজের কস্টার্জিত বিদেশী মুদ্রা বাবা মা বউ ছেলে মেয়েদের জন্য না পাঠিয়ে যখন নাইটক্লাবের নর্তকীদের নৃত্যের তালে তালে তাদের কোমড়ে গুজে দিয়ে নতুন এক অন্ধকার জগতে ডুবে যায়, তখন সে পরিবারটির দুঃখের আর অন্ত থাকেনা।
এমনি এক স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়ার নাইট ক্লাবগুলোতে নানা আয়োজনে শিল্পীদের নৃত্যের তালে তালে এক শ্রেণির প্রবাসী বাংলাদেশীদের লাখ লাখ টাকা উড়ছে দেদারসে। ভিনদেশি ও স্ব-দেশি শিল্পীদের অশ্লীল নৃত্য চলাকালে জনশক্তি রফতানির সাথে জড়িত বহু দালাল, প্রবাসী ব্যবসায়ী ও কিছু কিছু কর্মী দু’হাতে রিংগিট উড়িয়ে আনন্দ উল্লাসে রাত কাটাচ্ছে। নাইট ক্লাবগুলোর মালিকরা বৈধ লাইসেন্স নিয়ে এসব চটকদারী নৃত্যের আয়োজন করে রাতারাতি কালো টাকার মালিক বনে যাচ্ছে। মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর, পেনাংসহ বিভিন্ন অঞ্চলে কসমিকের নামে জুয়ার আসরেও বিপুলসংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশী হাজার হাজার রিংগিট বাজি ধরে পথে বসছে। দীর্ঘদিন মালয়েশিয়ায় অবস্থান করে কোনো কোনো বাংলাদেশী দেশটিতে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার সুবাধে নাইট ক্লাব ও জুয়ার আসরে আধিপত্য বিস্তার করছে। এক শ্রেণির দালালচক্র বাংলাদেশ থেকে কথিত মহিলা শিল্পীদের ভাড়া করে মালয়েশিয়ার নাইট ক্লাবগুলোতে রাতভর নৃত্য পরিবেশন করে টু’পাইস কামিয়ে নিচ্ছে। এসব দালাল চক্রের সাথে অনেক হোমরা-চোমরাদের দহরম মহরম রয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে মালয়েশিয়ার একাধিক প্রবাসী ব্যবসায়ী এ তথ্য জানিয়েছেন।
তাদের মতে, কুয়ালালামপুরস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশন কর্তৃপক্ষ এসব নাইট ক্লাবে যাওয়া পথভ্রষ্ট প্রবাসীদের সুপথে ফিরিয়ে আনার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বাংলাদেশ হাই কমিশন মালয়েশিয়া সরকারের সহায়তায় পেনাংসহ কুয়ালালামপুরের নাইট ক্লাব ও জুয়ার আসরগুলোতে মাঝে-মধ্যে অভিযান চালালে পথভ্রষ্ট প্রবাসীরা অনেকটা সুপথের সন্ধান পেত। এতে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা পুনরুদ্ধার এবং প্রবাসীদের কষ্টার্জিত রেমিটেন্স বিপথে নষ্ট কম হতো। বিদেশের মাটিতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কষ্টের কামানো লাখ লাখ টাকা চিত্তবিনোদনের নামে নিমেষেই হাতছাড়া হচ্ছে। ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে মালয়েশিয়ায় গিয়ে টাউট বাটপারের খপ্পরে পড়ে যারাই নাইট ক্লাবগুলোতে যাচ্ছে তাদের পরিবারগুলোই সর্বস্বান্ত হচ্ছে।
এসব পথভ্রষ্ট প্রবাসী কর্মীদের কেউ কেউ বছরের পর বছর দেশের বাড়িতে পিতা-মাতা ও স্ত্রী-সন্তানের সাথেও যোগাযোগ রাখছে না। সম্প্রতি এ প্রতিবেদক মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে সরেজমিনে গেলে একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র এমন তথ্য জানিয়েছে।
দেশীয় ও ভিনদেশীয় শিল্পীদের আকর্ষণীয় নৃত্য উপভোগ করে প্রতি রাতে প্রবাসী বাংলাদেশীরা হাজার হাজার রিংগিট উড়াচ্ছে। নাইট ক্লাবের নেশায় পড়ে প্রবাসী বাংলাদেশীদের অনেকেই সর্বস্ব খুয়িয়ে পথে বসেছে। এক শ্রেণির দালাল চক্র দেশ থেকে ছদ্মনাম লিপি, মায়া, সুজানা, রোজিনা, পাপিয়া চম্পা ও স্বপ্না নামের নৃত্য শিল্পীদের মালয়েশিয়ার নাইট ক্লাবগুলোতে এনে প্রতি মাসে লাখ লাখ রিংগিট হাতিয়ে নিচ্ছে। এতে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। এসব শিল্পীদের অশ্লীল নৃত্য উপভোগ করে প্রতিযোগিতামূলক উপহার দিতে গিয়ে প্রবাসীরা মোটা অংকের রিংগিট উড়াচ্ছে। নাইট ক্লাবগুলোতে বিনোদনের নামে যারাই নানা প্রক্রিয়ায় নৃত্য উপভোগ করছে তারা গ্রামের বাড়িতে পরিবারের সাথে সম্পর্ক রাখতে পারছে না। ফলে তাদের অধিকাংশ পরিবারই ঋণের বোঝা টানতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে। নাইট ক্লাবগুলো থেকে প্রবাসী কর্মীদের সুপথে ফিরিয়ে আনা এবং দেশীয় নৃত্য শিল্পীদের অবাধে নৃত্যের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে আনতে বাংলাদেশ হাই কমিশন কর্তৃপক্ষকে মালয়েশিয়া সরকারের সাথে দ্বি-পাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করছি।
এতে দেশের ভাবমর্যাদা অক্ষুন্ন এবং অপহরণের মতো অপরাধ প্রবণতা হ্রাস পাবে।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সংগঠক