পশ্চিমবাংলা থেকে লিখেছেন তরুণ মুখোপাধ্যায়ঃ চল্লিশের কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একবার লিখেছিলেন, ৩৬ হাজার লাইন কবিতা না লিখে যদি একটাও গাছ পুঁততেন, যথাযথ কাজ হতো। কেননা গাছ আমাদের ফল-ফুল-ছায়া এবং আশ্রয় দেয়। প্রকৃতি ও পরিবেশকে সুস্থ রাখে। বাঁচার প্রেরণা দেয়, শক্তি দেয়। তো এই ৩৬ সংখ্যাটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। প্রাসঙ্গিকভাবে একথা মনে এলো ফারুক আহমেদের প্রসঙ্গে। পশ্চিমবাংলার দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার ভাঙড় অঞ্চলের নাটাপুকুর গ্রামে তার জন্ম ১৯৮৩-র ৭ মার্চ। অর্থাৎ এখন সে ৩৬ বছরের তরতাজা যুবক।
না, যৌবনই শেষ কথা নয়। রবীন্দ্রনাথ যে “সবুজের অভিযান” চেয়েছিলেন, অর্ধচেতনদের জাগাতে বলেছিলেন, প্রাণ অফুরান ছড়িয়ে দিতে বলেছিলেন — ফারুক আহমেদ যেন সেই চিরযুবা। অক্লান্ত কর্মী। আর নিষ্ঠাবান সাহিত্য সেবক। ডা: মো: আবেদ আলি ও ফজিলা বেগমের সে কনিষ্ঠ পুত্র। গ্রামের স্কুলে পাঠ শেষ করে ঘটকপুকুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে ভাঙড় উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে পাশ করে। এরপর সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ইংরেজিতে স্নাতক হয়। গ্রন্থাগার বিজ্ঞান নিয়েও পড়ে। উচ্চতর শিক্ষালাভে ফারুক প্রথমে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস নিয়ে ও পরে ইন্দিরা গান্ধী জাতীয় মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম. এ. পাশ করে। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়েই সে গবেষণার জন্য বেছে নেয়। গবেষণার বিষয় — ‘অনগ্রসরদের সামাজিক সমস্যা ও উত্তরণ।’
স্নাতক পাঠ নিতে নিতেই ফারুক বাংলা সাহিত্য পাঠে আগ্রহী হয়। স্থানীয় ‘নজরুল-সুকান্ত পাঠাগার’-এ সে প্রচুর বই পড়ার সুযোগ পায়। ফারুক এখন কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসে কর্মরত।
এহো বাহ্য। ফারুক আহমেদ-র অন্যতম পরিচয়, পশ্চিমবাংলা থেকে প্রকাশিত একটি উন্নতমানের সাহিত্য পত্রিকার সে সম্পাদক। চমৎকার ও ব্যঞ্জনাধর্মী সেই পত্রিকার নাম — উদার আকাশ। অসাম্প্রদায়িক মনের রুচিশীল পত্রিকা। যেখানে সাহিত্য-সংস্কৃতি-ধর্ম-সমাজ সমান গুরুত্ব পায়। কোনও বিদ্বেষ নেই। রাজনীতির নানা তথ্য থাকলেও, কখনও উস্কানিমূলক লেখা থাকে না। সকলের জন্য এখানে উদার আমন্ত্রণ। যেন এক মুক্ত আকাশের নিচে মুক্তমনাদের নিয়ে মহামিলন। এখানে যারা লিখেছেন, লেখেন, তাঁরা কেউ কেউ পুরস্কৃত হয়েছেন। যেমন, আফসার আমেদ পেয়েছেন বঙ্কিম পুরস্কার। শেখ মকবুল ইসলাম জগন্নাথ নিয়ে গবেষণার জন্য পেয়েছেন ডি. লিট। আর ‘উদার আকাশ’ এই ২০১৯-এ তার নিরন্তর চর্চার জন্য পশ্চিমবঙ্গ ছোট পত্রিকা সমন্বয় সমিতির বিচারে প্রথম হওয়ার পুরস্কার পেয়েছে। ঈদ-শারোদৎসব সংখ্যার জন্য তার এই সম্মান লাভ। এর আগে ২০১২-তে পেয়েছিল ‘নতুন গতি’ পুরস্কার। অল ইন্ডিয়া ইমাম-মুয়াজ্জিন অ্যান্ড সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশন (মুর্শিদাবাদ জেলা) ২০১৬-তে সাংবাদিক ও সাহিত্যিক হিসেবে ফারুক আহমেদকে সম্মাননা জানায়। ২০১৭-তে ফারুক পেয়েছে ‘কথামালা ভারত-বাংলাদেশ-মৈত্রী’ সম্মাননা। নিখিল ভারত শিশু সাহিত্য সংসদও তাকে ‘চর্যাপদ’ পুরস্কারে সম্মান জানায়। এছাড়াও বহু পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছে ফারুক আহমেদ।
পত্রিকা সম্পাদনা ও সাহিত্য সাধনায় ফারুক আহমেদ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের প্রেরণা ও পরামর্শ পেয়েছে। মহাশ্বেতা দেবী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শঙ্খ ঘোষ, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আবুল বাশার প্রমুখ তার শুভানুধ্যায়ী। মোস্তাক হোসেনের সানুরাগ সান্নিধ্য সে পেয়েছে।
সম্পাদক ফারুক আহমেদ নিজেকে আড়াল রেখে ভালো লেখা আর লেখককে প্রাধান্য দিতে চায়। এটা তার বড় গুণ। যদিও নিজে সে কবি, ছড়াকার, গল্পকার, প্রাবন্ধিক। আছে একাধিক গ্রন্থ। জীবিকার দায় মিটিয়ে সাহিত্য সেবায় সে নিষ্ঠাবান। এর পাশে সামাজিক নানা কাজে ও আন্দোলনেও সে জড়িত থাকে। প্রণব মুখার্জি, অমর্ত্য সেন কিংবা মুখ্যমন্ত্রী মাননীয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আশীর্বাদও তার পাথেয়।
পত্রিকা প্রকাশের পাশাপাশি ফারুক প্রকাশনার কাজেও যুক্ত। একাধিক ভালো বই সে প্রকাশ করেছে। খ্যাতনামা, স্বল্পখ্যাত বহু লেখক সেই তালিকায় আছেন। দূরদর্শন বা অন্যান্য সংবাদ মাধ্যমেও তার কথা প্রচারিত হয়। ২০১৯-এই কলকাতায় ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী উৎসব হতে চলেছে তারই উদ্যোগে। তার কর্মকাণ্ড এখানেই শেষ নয়।
আজকের পৃথিবীতে পরিবেশ বিপন্ন। বৃক্ষরোপণ উৎসব একদা শুরু করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বিশ্বভারতীতে আজও সাড়ম্বরে তা পালিত হয়। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগের উদ্যোগে সেই বৃক্ষরোপণ উৎসবে সামিল হয়েছে অফিস কো-অর্ডিনেটর ফারুক আহমেদও। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সুরক্ষা, উন্নতিতেও ফারুক আহমেদ সোচ্চার। এর পাশে তার কবি সত্তাকে সযত্নে সে লালন করে চলেছে। তার ‘দেশপ্রেমিক’ কবিতার প্রথম স্তবক পড়া যাক —
নাফার চোখের দিকে তাকাও
অফুরন্ত সৃষ্টি খেলা করে ও চোখে
ওকে মেরো না, ওকে বাঁচতে দাও
ওর কাছ থেকে চেয়ে নাও
মিত্রতা-ভালোবাসা-মনুষ্যত্ব-মানুষ
অবাঞ্ছিত ভেবে ঘৃণা করো না।
কিংবা ২১শে ফেব্রুয়ারি স্মরণে ফারুক আহমেদ লেখে —
প্রাণের বাংলা ভাষা
তোমার জন্য বিস্তীর্ণ আকাশ
দিগন্তব্যাপী খোলা মাঠ
হাতে হাত
প্রাণের বাংলা ভাষাতেই জানাই
ভালবাসি তোমায়…
আরেকটি কবিতা ‘আমার না-পাওয়া প্রেম তানিয়া’। ভাষা প্রেমেই লেখে,
তানিয়া মনে পড়ে ২১ ফেব্রুয়ারি
ভাষার জন্য তোমার জন্য
এ বুকে আজও আকাশ রাখা।
এই ফারুকই বলতে পারে, ‘ভালবাসার জন্য বাঁচো, বাঁচার মত বাঁচো।’
‘একটা না-কবিতা’য় পড়ি, স্ত্রী ও কন্যার প্রতি গভীর প্রেম, স্নেহ। যেখানে কবির অনুভব —
অনন্ত ভালবাসা নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে
ভালবাসার একটা চুম্বন
অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে
অপেক্ষালয় হয়েছে।
‘এক আকাশ প্রেম’ নিয়ে ফারুক আহমেদ এগিয়ে চলুক।