(বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার করা হয়েছে ছাত্রলীগের নয় নেতাকর্মীকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গত রোববার রাতে বুয়েট ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আবরারকে হত্যা করে। এই হত্যার ঘটনায় ছাত্রসমাজসহ গোটা দেশ মুহ্যমান। ঢাবি, বুয়েটসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা মানববন্ধনসহ বিবিধ প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেন। হত্যার সুষ্ঠু বিচার দাবি করে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।অপ্রত্যাশিত, অযৌক্তিক, অনাকাক্সিক্ষত আবরারের মৃত্যু অপরাধী করে দিয়েছে সংবেদনশীল মানুষকে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে সাতটি প্রকল্পের উদ্বোধনসহ তিনটি চুক্তির প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন আবরার। ধারণা করা হচ্ছে, এই ‘অপরাধে’ ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা ফোন কলে ডেকে নেন এরপর তাকে বেধড়ক পিটিয়ে আহত করে। পরে রক্তক্ষরণে মারা যান আবরার। কুষ্টিয়া নিবাসী আবরারের পরিবারের সদস্যরাও বুঝতে পারছেন না, কী অপরাধে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড!মৃত্যুর ঘটনায় শাখা ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদকসহ ১৯ জনকে আসামি করে মামলা করেছেন নিহতের বাবা বরকতুল্লাহ। সোমবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে রাজধানীর চকবাজার থানায় মামলা করেন তিনি। ছেলে হত্যার ঘটনায় তিনি ১৯ জনকে আসামি করে মামলা করেছেন। সিসিটিভি ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করে ১৯ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। মামলায় প্রধান আসামি মেহেদী ও দ্বিতীয় আসামি ফুয়াদকে করা হয়েছে। মামলার কার্যক্রম শেষ হলে মরদেহ বুয়েটে নেওয়া হবে বলে জানান আবরারের বাবা। সেখানে জানাজা শেষে কুষ্টিয়ার গ্রামের বাড়িতে নেওয়া হবে।নিহত আবরার ফাহাদ (২১) বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের (ইইই) বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। থাকতেন শেরেবাংলা হলের ১০১১ নম্বর কক্ষে। গত শনিবার বিকাল সাড়ে ৫টায় নিজের ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস পোস্ট করেছিলেন তিনি। সেখানে বাংলাদেশ-ভারতের সাম্প্রতিক প্রকল্প ও চুক্তিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদিকে ইঙ্গিত করে তিনি লিখেন-
১. ৪৭-এ দেশভাগের পর দেশের পশ্চিমাংশে কোনো সমুদ্রবন্দর ছিল না। তৎকালীন সরকার ছয় মাসের জন্য কলকাতা বন্দর ব্যবহারের জন্য ভারতের কাছে অনুরোধ করল। কিন্তু দাদারা নিজেদের রাস্তা নিজেদের মাপার পরামর্শ দিয়েছিল। বাধ্য হয়ে দুর্ভিক্ষ দমনে উদ্বোধনের আগেই মোংলা বন্দর খুলে দেওয়া হয়েছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ ইন্ডিয়াকে সেই মোংলা বন্দর ব্যবহারের জন্য হাত পাততে হচ্ছে।
২. কাবেরী নদীর পানি ছাড়াছাড়ি নিয়ে কানাড়ি আর তামিলদের কামড়াকামড়ি কয়েক বছর আগে শিরোনাম হয়েছিল। যে দেশের এক রাজ্যই অন্যকে পানি দিতে চায় না সেখানে আমরা বিনিময় ছাড়া দিনে দেড় লাখ কিউবিক মিটার পানি দেব।
৩. কয়েক বছর আগে নিজেদের সম্পদ রক্ষার দোহাই দিয়ে উত্তরভারত কয়লা-পাথর রপ্তানি বন্ধ করেছে অথচ আমরা তাদের গ্যাস দেব। যেখানে গ্যাসের অভাবে নিজেদের কারখানা বন্ধ করা লাগে সেখানে নিজের সম্পদ দিয়ে বন্ধুর বাতি জ্বালাব।
হয়তো এ সুখের খোঁজেই কবি লিখেছেন- ‘পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি/ এ জীবন মন সকলি দাও,/ তার মতো সুখ কোথাও কি আছে/ আপনার কথা ভুলিয়া যাও।’
ব্যক্তিগত মতামতধর্মী ওই স্ট্যাটাসটির পরিপ্রেক্ষিতে গত রোববার রাতে আবরারকে ডেকে নিয়ে মারধর করেন ছাত্রলীগ কর্মীরা। এরপর রাত ৩টার দিকে বুয়েটের শেরেবাংলা হলের সিঁড়ি থেকে আবরারের লাশ উদ্ধার করা হয়। তার সহপাঠীরা জানান, রোববার রাত ৮টার দিকে শেরেবাংলা হলের ১০১১ নম্বর কক্ষ থেকে কয়েকজন আবরারকে ডেকে নিয়ে যায়। এরপর রাত ২টা পর্যন্ত তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
উল্লেখ্য, ছাত্রলীগ-যুবলীগে বর্তমানে চলছে শুদ্ধি অভিযান। চাঁদাবাজির অভিযোগে অভিযুক্ত কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে পদচ্যুত করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপে।
এর অব্যবহিত পরই গ্রেফতার করা হয় যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, জি কে শামীম, ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, কৃষক লীগ নেতা শফিকুল আলম ফিরোজকে। তারা বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে রয়েছেন। দেশবাসীর দৃষ্টি যে সময়ে শুদ্ধি অভিযানে নিবদ্ধ, ঠিক সে সময়ে বুয়েটের মতো নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা মামুলি ফেসবুক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র এমন হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করল! এ ইস্যুতে সরব ফেসবুক।
আবরার ফাহাদকে হত্যার ঘটনায় ছাত্রলীগের নয়জন নেতাকে আটক করা হয়েছে। আটককৃত সবাই বুয়েট ছাত্রলীগের পদে আছেন। সোমবার সন্ধ্যায় ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় আটকের তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, আবরার ফাহাদ হত্যার ঘটনায় শনাক্ত নয়জনকে আটক করেছি। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। আমরা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পেয়েছি। সেটা পর্যালোচনা করছি।
আটককৃতরা হলেন- বুয়েট শাখা ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল, সহসভাপতি মুস্তাকিম ফুয়াদ, সহসম্পাদক আশিকুল ইসলাম বিটু, উপ-দফতর সম্পাদক মুজতবা রাফিদ, উপ-সমাজকল্যাণ সম্পাদক ইফতি মোশাররফ সকাল, উপ-আইন সম্পাদক অমিত সাহা, ক্রীড়া সম্পাদক সেফায়েতুল ইসলাম জিওন, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার, গ্রন্থ ও গবেষণা সম্পাদক ইশতিয়াক মুন্সি। গোয়েন্দা সংস্থার বক্তব্য অনুযায়ী, ছাত্রলীগের বুয়েট শাখার গ্রন্থনা ও গবেষণা সম্পাদক এবং মেকানিক্যাল ডিপার্টমেন্টের ১৫ ব্যাচের শিক্ষার্থী ইশতিয়াক মুন্নার নির্দেশেই সংঘটিত হয় এই হত্যাকাণ্ড।
আবরারকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় ছাত্রলীগের কেউ জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন সংগঠনটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়। গতকাল দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) মধুর ক্যান্টিনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে জয় বলেন, ছাত্রলীগ কখনই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়নি।
বুয়েটের এ ঘটনায় যদি ছাত্রলীগের কোনো নেতাকর্মী বিন্দুমাত্র জড়িত থাকে, অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অনুরোধ জানাব, সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের দ্রুত গ্রেফতার করুন।
তিনি জানান, এ ঘটনায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সহসভাপতি ইয়াজ আল রিয়াদ ও সাধারণ সম্পাদক আসিফ তালুকদারকে নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
আবরার হত্যার প্রতিবাদে গতকাল বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাবি ও বুয়েট। গতকাল দুপুর ১২টার দিকে ঢাবির রাজু ভাস্কর্য থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। মিছিলটি ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে বুয়েট ক্যাম্পাসে অবস্থান নেয়। এ সময় ‘বিজেপির দালালরা, হুঁশিয়ার সাবধান’, ‘ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই, আবরার হত্যার ফাঁসি চাই’, ‘ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা, হুঁশিয়ার সাবধান,’ ‘হলে হলে দখলদারিত্ব, বন্ধ কর করতে হবে’, ‘সিসিটিভি ফুটেজ গায়েব কেন? প্রশাসন জবাব চাই’ এমন স্লোগান দেওয়া হয়। বিক্ষোভে অংশ নেন কয়েকজন শিক্ষকও।
একাত্মতা পোষণ করে বিক্ষোভ-মিছিলে যোগ দেন ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুর। প্রতিবাদ সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নেয় বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্র ফেডারেশনসহ ক্যাম্পাসের বিভিন্ন প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন।
আবরার হত্যায় প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সোহেল মাহমুদ গতকাল দুপুরে এ কথা জানান। তিনি বলেন, ময়নাতদন্তে আবরারের দেহে জখমের অনেক চিহ্ন পাওয়া গেছে।আবরারের মা রোকেয়া খাতুন কুষ্টিয়ার একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষক। ছেলের হত্যাকারীদের খুঁজে বের করার দাবি জানিয়ে বলেন, গতকাল (রোববার) সকালে আমি তাকে নিজে গিয়ে বাসে তুলে দিই। সে ঢাকায় রওনা দেয়। মাঝে তিন থেকে চারবার ছেলের সঙ্গে কথা হলো আমার। বিকাল ৫টায় হলে পৌঁছে ছেলে আমাকে কল করে। এরপর আর কথা হয়নি। রাতে অনেকবার কল করেছিলাম, ধরেনি।আবরারের ছোটভাই কলেজছাত্র আবরার ফায়াজ বলেন, ফোন না ধরায় আমি ফেসবুকের মেসেঞ্জারে ভাইয়াকে নক করি। ভাইয়া সে সময়ও ফেসবুকে অ্যাকটিভ ছিল। তবে সাড়া দেয়নি। রোকেয়া বেগম ও প্রতিবেশীদের কণ্ঠেও বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে একটি বাক্য- এত মেধাবী, শান্ত ছেলেটিকে কে হত্যা করতে পারে!একটি পক্ষ আবরারকে শিবিরকর্মী হিসেবে প্রচার করতে চাচ্ছে। এ বিষয়ে নিহতের চাচা মিজানুর রহমান বলেন, এটা বানোয়াট, আমরা সবাই আওয়ামী লীগ সমর্থক। হানিফ (মাহবুব-উল আলম হানিফ) সাহেবের বিভিন্ন মিটিংয়েও আমরা যাই। আবরার এমনিতে তাবলিগে যেত। বুয়েটে ভর্তির পর দুই-তিনবার তাবলিগে গিয়েছিল।আবরারের বাবা বরকতুল্লাহ বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের নিরীক্ষক কর্মকর্তা ছিলেন। দুই ভাইয়ের মধ্যে আবরার বড়। ছোটভাই ফায়াজ ঢাকা কলেজের উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। সে ঢাকা কলেজের হোস্টেলে থাকে। বুয়েটের শেরেবাংলা হলের কাছেই তার হোস্টেল। তাদের আওয়ামী লীগ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফের বাসার পাশেই।ছেলে হত্যার কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না আবরারের মা। তিনি বলেন, আমার ছেলের কোনো শত্রু ছিল না। আমাদের পুরো পরিবার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সমর্থক। এরপরও কেন তাকে হত্যা করা হলো? হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাই।