যুদ্ধাপরাধসহ অর্ধশত নাশকতা মামলার পলাতক আসামি জামায়াত নেতা রাজাকার মাওলানা আকবর আলীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তিনি কালিগঞ্জ উপজেলার ইন্দ্রনগর গ্রামের মুত শেখ জবেদ আলীর পুত্র। ১০টি মামলায় তার বিরুদ্ধে কালিগঞ্জ থানায় গ্রেফতারি পরোয়ানা মূলতবি আছে।
আকবর আলী যুদ্ধাপরাধী মামলাসহ ২০১৩ সালে নাশকতায় অভিযোগে সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন থানায় প্রায় ৫০ টিরও বেশি মামলায় আত্মগোপনে ছিলেন। তবে তিনি আত্মগোপনে থেকেও তার পুত্রদের সহযোগিতায় স্বাক্ষর জালিয়াতি করে ৩৭ লক্ষ ৭৭ হাজার ৫০৫ টাকা কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর ভাতা উত্তোলন করেছেন।
বুধবার রাত ১০ টার দিকে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার ব্রজবক্স গ্রামে তার মেয়ের বাড়ি থেকে এক যৌথ অভিযানে গ্রেপ্তার করা হয়। সাতক্ষীরা জেলা পুলিশ ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই), সাতক্ষীরা এই অভিযানে অংশ নেয়। সাতক্ষীরা জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান পিপিএম(বার) নিজে এই অপারেশনের নেতৃত্ব দেন। এছাড়াও অপারেশনে সাতক্ষীরা জেলা গোয়েন্দা পুলিশ, এসবি, কলারোয়া থানা পুলিশের একাধিক দল অংশগ্রহণ করেন।
আকবর আলীর বিরুদ্ধে ২০০৯ সালে যুদ্ধাপরাধের মামলা দায়ের হয়, যার নং জিআর ৯২/৯, কালিগঞ্জ।
২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হলে মাওলানা আকবর নিজেকে বাঁচাতে আত্মগোপনে চলে যান। এরপর ২০১৩ সালে বিএনপি-জামাতের নেতৃত্বে দেশে নাশকতা শুরু হলে রাজাকার মাওলানা আকবর আলী সরকার পতনের লক্ষ্যে জামায়াতের হাইকমান্ডের নির্দেশে আবারো এলাকায় ফিরে নাশকতায় অংশগ্রহণ করেন। এরপর পলাতক থাকা অবস্থায় পেনশনের প্রায় ৩৮ লক্ষ টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে উত্তোলন করেন। দীর্ঘদিন ধরে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা তাকে খুঁজছিল।
সেদিন ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ দিনটি ছিল মঙ্গলবার বেলা আনুমানিক বিকেল ৪ থেকে সাড়ে ৪ টা। ঘটনাটি সাতক্ষীরা জেলার কাালিগঞ্জ উপজেলার নলতা হাটখোলায় পুত্র গোলাম মোস্তফাকে নিয়ে বাজার করতে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী দেবহাটা উপজেলার জগন্নাথপুর গ্রামের রহমাতুল্যাহকে পুত্রর সামনেই নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল রাজাকার কমান্ডার কালিগঞ্জ উপজেলার ইন্দ্রনগর গ্রামের মুত শেখ জবেদ আলীর পুত্র আকবর আলী।
১৯৭১ এর বিভীষিকাময় সময়ে কালিগঞ্জ উপজেলার নলতা হাটখোলার পার্শবর্তী দেবহাটা উপজেলার জগন্নাথপুর গ্রামের রহমাতুল্যাও স্বপ্ন দেখেছিল একটি স্বাধীন বাংলার। তাই দেশকে পাক বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করতে বয়সের ভারে মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে না পারলেও মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন তিনি। যুদ্ধচলাকালীন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারদের সাথেও তার ছিল নিয়মিত যোগাযোগ। তারই প্রেক্ষিতে ১৯৭১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার বিকাল আনুমানিক ৪ অথবা সাড়ে ৪ টার দিকে নিকটস্থ নলতা বাজারে ছেলে গোলাম মোস্তফাকে সাথে নিয়ে বাজার করতে আসেন রহমাতুল্যাহ। বাজারে এসেই দেখা হয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার পূর্ব নলতা গ্রামের আনছার মাহমুদের সাথে। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আনছার মাহমুদ ও সহযোগী রহমাতুল্যার সাথে কুশল বিনিময় হয়। মুক্তিযোদ্ধা আনছার মাহমুদ রহমাতুল্যাকে চাচা বলে সম্বধন করতেন। তখন মুক্তিযোদ্ধা আনছার মাহমুদ সহযোগী রহমাতুল্যাকে বলেন “চাচা আমরা অতি শিঘ্রই দেশকে পাক বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করবো। আপনারা আমাদের সহযোগীতা করেন।” তখন রহমাতুল্যাহ মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মান দেখিয়ে হাত তুলে সালাম প্রেরণের মাধ্যমে স্বপ্নের একটি স্বাধীন বাংলাদেশকে সম্মান প্রদান করেন।
তার কিছুক্ষণ পরেই উক্ত মুক্তিযোদ্ধা আনছার মাহমুদ পাক সেনাদের গাড়ি লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছোড়ে। কিন্তু তাহা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়।
খবর পেয়ে কুখ্যাত রাজার কমান্ডার আকবর আলী তার রাজাকার বাহিনী নিয়ে নলতা বাজারে পৌঁছে এলোপাতাড়ি গুলি করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে।
মুক্তিযোদ্ধা আনছার মাহমুদের সাথে মুক্তিযোদ্ধা সহযোগী রহমাতুল্যার কথা হয়েছে এটা জানতে পেরে রাজাকার কমান্ডার আকবর আলী রহমাতুল্যার কোমরের উপরে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে এবং আকবর আলীর নির্দেশে অন্য এক রাজাকার ধারালো অস্ত্র দিয়ে রহমাতুল্যার কোমর থেকে বুক পর্যন্ত নৃশংসভাবে চিরে দেয়। গোলাম মোস্তফা নিজ চোঁখে রাজাকার আকবর আলী এমন নৃশংসভাবে তার বাবাকে হত্যা করা দেখেও তাৎক্ষনিক কোন প্রতিকার করতে সাহস পায়নি।
বাবা রহমাতুল্যার মৃত্যুর পর সংসারের হাল পুত্র গোলাম মোস্তফাকে ধরতে হয় ফলে সংসারে চরম অবনতি ও অভাব নেমে আসে। পরবর্তীতে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে চরম দরিদ্রতার মধ্যে পড়ে গোলাম মোস্তফার পরিবার।
এদিকে রাজাকার বাহিনী কমান্ডার আকবর আলীর হাতে নৃশংসভাবে রহমাতুল্যাহ হত্যার বিষয়ে তদন্ত হলেও তা অজানা কারণে ধামাচাপা পড়ে যায়।
পরবর্তীতে দেশের রাজনৈতিক পঠ পরিবর্তন হলে সুষ্ঠ বিচার প্রত্যাশা না থাকায় গোলাম মোস্তফা তার পিতার খুনের বিষয়ে কোন প্রতিকার প্রার্থনা করেনি। পরে ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহাজোট ক্ষমতাসীন হওয়ায় এবং ন্যায় ও সুষ্ঠ বিচারের প্রত্যাশায় বহু বিলম্ব হওয়া সত্তেও রহমাতুল্যার পুত্র প্রতাক্ষদর্শী গোলাম মোস্তফা ২০০৯ সালে ২৫ জুন রাজাকার আকবর আলীকে আসামী করে সাতক্ষীরা অতিঃচিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মানবতা অপরাধী মামলা দায়ের করেন যার মামলা নাম্বার জি.আর-৯২/৯, কালিগঞ্জ।
তথ্যানুসন্ধানে যানা যায়, এই মামলায় পূর্বনলতা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আনছার মাহমুদ, ইন্দ্রনগর গ্রামের মোহর আলী পুত্র আব্দুল আজিজ, ইছাপুর গ্রামের কামাল উদ্দীনের পুত্র জমাত আলী বিশ্বাস, একই গ্রামের পুটে বিশ্বাসের পুত্র জনাব আলী কোলু এবং ইন্দ্রনগর গ্রামের বাছতুল্যা শেখের পুত্র শেখ ধনির উদ্দীন মেম্বার কে স্বাক্ষী করে সাতক্ষীরা অতিঃচিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা দায়ের করলে আদালত থেকে মামলাটি তদন্তের জন্য ২০০৯ সালের ১ জুলাই কালিগঞ্জ থানায় প্রেরণ করেন। পরবর্তীতে স্বাক্ষীদের স্বাক্ষগ্রহণ এবং তথ্য প্রমানের ভিত্তিতে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে ২০০৯ সালের ১০ জুলাই কালিগঞ্জ থানা মামলাটি গ্রহণ করে যার নাম্বার-০৭ ধারা ৩০২ পেনাল কোডে রুজু করেন।
তবে বর্তমান এই মামলার ৫ জন স্বাক্ষীদের মাধ্যে ৩ জনের মুত্যু হয়েছে এবং বাকি দুইজন ইন্দ্রনগর গ্রামের আব্দুল আজিজ এবং ইছাপুর গ্রামের জামাত আলি বিশ্বাস জীবিত আছেন।
জানতে চাই মামলার স্বাক্ষী জামাত আলি বিশ্বাস ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, আমি মুক্তিযুদ্ধের সময় দেখেছি আকবর আলী পাকিস্থানি মিলিটারিদের সাথে থাকতো এবং তাদের সাথে থেকে এলাকায় বিভিন্ন অপকর্ম সে করতো। আমরা এই রাজাকারের বিচার চাই।
মামলার আরেক স্বাক্ষী আব্দুল আজিজ বলেন, আকবর আলী মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতা বিরোধী অপরাধের মত কর্মকান্ডে লিপ্ত ছিলো।
পরবর্তীতে মানবতা বিরোধী অপরাধের মামলা ও ২০১৩ সালের নাশকতা মামলা আকবর আলীসহ তারা পুত্ররা আত্মগোপনে যাওয়ার পরে স্থানীয় সংসদ সদস্যর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে আদালত থেকে জামিন নিয়ে ছেলেরা এলাকায় ফিরে আসলে ফিরতে পারেনি রাজাকার আকবর আলী।
মামলার বাদী নিহতের পুত্র গোলাম মোস্তফা বলেন, আমার পিতা রহমাতুল্যাহ দেশকে পাক বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করতে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করতো এই অপরাধে রাজাকার কমান্ডার আকবর তার দলবল নিয়ে আমার বাবাকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। সেদিনের ঘটনার কথা মনে পড়লেই আমার এখনো শরীরের লোম শিহরণ দিয়ে ওঠে। স্বাধীনতার ৪৮ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো আমার বাবার হত্যার বিচার পেলাম না। আমি আমার বাবার হত্যার আসামী কুখ্যাত পালাতক রাজাকার আকবর আলীকে গ্রেফতার করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দৃষ্টান্তমুলক বিচার চাই।
অভিযুক্ত আকবর আলির কাছে এসব বিষয়ে জানার চেষ্টা করলে তিনি অর্ধযুগেরও বেশি পালাতক থাকার কারণে তার সাথে কোনভাবেই যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
তবে ব্যাপারে সাতক্ষীরা-৩ আসনের সংসদ সদস্য অধ্যাপক ডাঃ আ ফ ম রুহুল হকের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি ইতিপূর্বে শুনেছি আকবর আলী ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এলাকায় রাজাকার কমান্ডার হিসেবে পাকিস্থানি হায়েনাদের সাথে কাজ করতো। এখনও এই কুখ্যাত আকবর আলী ইন্দ্রনগর মাদ্রাসায় অধ্যাক্ষ হিসেবে থাকা অবস্থায় দূর্ণীতির শীর্ষে পদার্পন করে প্রায় অর্ধলক্ষ টাকা অবসর ভাতা ও কল্যান ট্রাস্টের টাকা উত্তোলন করেছে। আইনি সংস্থা যাতে এই রাজাকারকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমুলক শাস্তিু প্রদান করে সেই আশাবাদ ব্যক্ত করছি।
তবে এলাকা ঘুরে জানা যায় যে, রাজাকার আকবর আলী যুদ্ধাপরাধী মামলাসহ ২০১৩ সালে নাশকতায় অভিযোগে সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন থানায় প্রায় ৫০ টিরও বেশি মামলায় আত্মগোপনে চলে যায়। তবে তিনি আত্মগোপনে থেকেও প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে স্বাক্ষর জালিয়াতি করে অলৌকিকভাবে ৩৭ লক্ষ ৭৭ হাজার ৫০৫ টাকা কল্যান ট্রাস্ট ও অবসর ভাতা উত্তোলন করছে।
তবে জানাযায় এখনও পর্যন্ত রাজাকার আকবর আলী বাংলাদেশের অস্তিত্বকে বিশ্বাস করে না। যখন সে এলাকায় ছিল তখন প্রকাশ্য স্বাধীনতা যুদ্ধকে ভন্ডামি বলে আখ্যায়িত করতো। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে নানা রকম অশ্লিল বাক্য ব্যবহার করতো। এবং যদি তারা কোনদিন আবার সুযোগ পায় তাহলে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা করা হবেনা বলেও উদ্ধর্ত্যপূর্ণ বক্তব্য দিতো। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় শূরা সদস্য।