কিছু স্মৃতি মানুষের হৃদয়ে দারুণ ভাবে গেঁথে যায়। আর যাঁরা সংস্কৃতি চর্চা, সাহিত্য চর্চায় আত্মনিয়োগ করে তাদের হৃদয় ফুলের পাপড়ির মতন কোমল। তাঁরা পৃথিবীতে যেভাবে বিচরণ করে সাধারণ মানুষ সেভাবে পৃথিবীতে পথ চলেনা। উত্তরবঙ্গের মানুষ আমি,অথচ কখনো টাঙ্গাইল যাইনি।এটা আমার জীবনের এক কষ্টের জায়গা ছিলো। এই কষ্টের জায়গাটা এবার লাঘব হয়ে গেলো সত্তর দশকের শ্রদ্ধেয় কবি ও সংগঠক মাহমুদ কামাল ভাই এর স্নেহের দাওয়াতে। সাধারণ গ্রন্থাগার আয়োজন করে টাঙ্গাইলে বাংলাদেশের বৃহৎ কবিতা উৎসব হয়। কবিতা উৎসব মানেই কবি, সাহিত্যিকদের মিলনমেলা। একজন মানুষ। একজন সংগঠক। একজন কবি। তিন সত্ত্বার সমন্বয়ে গঠিত কবি মাহমুদ কামাল। তিনি এবারের আসরে বাংলাদেশ ও ভারতের চারশত জন কবিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আমি বিস্মিত। হতবাক।একজন তরুণ শব্দচাষী হিসেবে। কবিদের আবাসন, আপ্যায়ন, সব কিছুতেই একটা অচিন্তনীয় রুচির ছাপ আমি দেখেছি। নব্বই দশকের কবি হিসেবে অনেক কবিতার আসরে গিয়েছি।কিন্তু সব আসরের মধ্যে এটা আমার কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। মানুষ যখন সৎ মানসিকতায় কোনো মহৎ কাজে এগিয়ে যান,তখন সেই কাজ দারুণ ভাবে সফলতার মুখ দেখে। স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাও তাঁকে সহায়তা করেন অদৃশ্যের অন্তরালে থেকে। আমি এটা দেখলাম মাহমুদ কামাল ভাই এই আয়োজনে উপস্থিত থেকে। নিজেকে ভাগ্যবান মনে হলো এমন এক সুশৃঙ্খল কবিতা উৎসবে থাকতে পেরে।
বাংলাদেশ ও ভারতের অনেক কবিবন্ধুর সঙ্গে দেখা হলো। অনেকের সঙ্গে আমার রয়েছে হরিহরাত্মা সম্পর্ক। সেই সম্পর্কে নতুন মেরুকরণ হলো এবার কবিতা উৎসবে যোগদান করে। টাঙ্গাইলে আমার ভাই ও কবি কুশল ভৌমিকের ভালোবাসা চিরটাকাল মনে থাকবে আমার। কবি রুদ্র মোস্তফা তরুণতম বন্ধু আমার। তাঁর আন্তরিকতা ও শ্রদ্ধার জায়গাটা নিখাঁদ। দেখা হয়েছে মুজাহিদ ফারুক এর সাথে। দৌড়ে এসে বলেছেন, অনুষ্ঠান নিয়ে ঝামেলায় আছি ভাই। সময় দিতে পারছিনা বলে দুঃখিত। এই যে সরল সহজ সত্য উচ্চারণ এখানে নেই কোনো কপটতা।আছে ভালোবাসা। তিনটা দিনই কুশল ভৌমিক তাঁর শত ব্যস্ততার মধ্যে আমাকে সময় দিয়েছেন। এটা স্মরণীয়। প্রথম দিন বিকেল পাঁচটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত হোটেল প্রিন্স এর চারশত তিন নাম্বার রুমের কবিতা আড্ডার রেশ থেকে যাবে বহুকাল। কোলকাতার আশির দশকের গুরুত্বপূর্ণ কবি সৌমিত বসু দাদার সঙ্গে বাংলা কবিতা নিয়ে এই আড্ডা নানা কারণে স্মরণীয়। আমরা কবিতা পড়লাম সকলেই। কবি শান্তনুু প্রধান, কবি খৈয়াম কাদের, কবি কুশল ভৌমিক, কবি তৌফিক জহুর ও কবি সৌমিত বসু। প্রত্যেকের কবিতা নিয়ে কথা বললেন কবি সৌমিত বসু। আমার কবিতার বর্ণনা ঢঙ নিয়ে তিনি কিছু বিষয় বললেন, যা এর আগে কখনো কেউ বলেনি। কি কি বিষয় কমাতে হবে আর কোন কোন জায়গা ঠিক করতে হবে তা নিয়ে তিনি কথা বলেছেন।এটা একজন অগ্রজ কবির কাছ থেকে পরম পাওয়া। বাংলা সাহিত্যে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গদ্যভাষায় কবিতা নিয়ে কথা বললাম। তিনি খুব মনোযোগ সহকারে শুনলেন। তিন ঘন্টা আমরা কবিতার সাগরে সাঁতার কেটে ফিরে গেলাম অনুষ্ঠান স্থলে।
দ্বিতীয় দিন সকালে দেখতে গেলাম ১৬০৯ সালে নির্মিত বিখ্যাত আতিয়া মসজিদ। চারশত বছর আগে এমন শৈল্পিক সৃষ্টি কোনো প্রকৌশলী করেছেন তা জানতে হৃদয় আকুপাকু করছিলো। আমরা গেলাম বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাশের গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায়ের মাজারে। তিনি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। দু’ঘন্টা ঘোরাঘুরি করে আমরা চলে এলাম অনুষ্ঠান স্থলে। দুপুর থেকে কবিতা পাঠ ও কবিতা বিষয়ক আলোচনা শুনলাম।বিকেলে মঞ্চে উঠলাম কবিতা পাঠ করার জন্য। কবিতা পাঠ করার আগে জায়ান্ট স্ক্রিনে কবির ছবি ও পরিচিতি ভেসে উঠছে। একজন কবি প্রসঙ্গে বলছেন, তারপর কবি কবিতা পাঠ করছেন। কবিতা পাঠ শেষে একটা সন্মাননা ক্রেস্ট কবিকে উপহার দেয়া হচ্ছিল। এটাও প্রত্যেক কবির জন্য সন্মানের।
তৃতীয় দিন সকালের নাশতা আমি, কুশল ভৌমিক ও রুদ্র মোস্তফা করতে গেলাম কবি সৌমিত বসু দাদার সঙ্গে। কবি সৌমিত বসু দাদার সঙ্গে নাশতা মানে আমরা আবার প্রবেশ করলাম কবিতার আঙিনায়। নাশতা চলতে থাকলো আমরা আলাপ জমালাম কবিতা নিয়ে, গদ্য নিয়ে। কফি পর্ব পর্যন্ত চললো আমাদের অলিখিত সাহিত্য আড্ডা। এরপর আমরা ফিরে এলাম অনুষ্ঠান স্থলে।
অনেক কবি সাহিত্যিক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলো। সবার নাম আমি লিখিনি কিন্তু যাঁদের সঙ্গে দেখা হয়েছে তাঁদের ছবি আমি পোস্ট দিলাম। ষাট,সত্তর, আশি, নব্বই দশকের সমসাময়িক কবিবন্ধুদের সঙ্গে রাতের আড্ডা ছিলো জমজমাট। ঐতিহাসিক আনন্দময়ী চত্বরে আমরা দুইরাত আড্ডা দিয়েছি নব্বই দশকের বন্ধুরা। এই ঐতিহাসিক জায়গায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এসেছিলেন। আমরা পাথরে খোদাই করা নামের তালিকা দেখলাম। এমন এক বিখ্যাত জায়গায় বংশ পরম্পরায় চা বিক্রি করছেন পিন্টু বসাক। তাঁর সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর তিনি নিয়ে গেলেন সেই ঐতিহাসিক জায়গায়, যেখানে বিখ্যাত মানুষদের কদম একদিন পরেছিল।
মিষ্টি পট্টি ঘুরে ঘুরে দেখেছি। গোপাল মিষ্টিঘরে ঢু মেরেছি। কিভাবে চমচম ও ছানার রসালো মিষ্টি তৈরি হচ্ছে তা স্বচক্ষে দেখে জ্ঞান অর্জন করেছি। জানার কোনো শেষ নেই।
কবিতা জীবনের কথা বলে। কবিতা সমাজের কথা বলে। কবিতা একটা রাষ্ট্রের ফুলবাগান। যে ফুলের সৌরভে সাধারণ মানুষ আমোদিত হয়। নিঃশ্বাস নেয়, নিঃশ্বাসে মিশে যায় ফুলের সৌরভ। তিনদিন টাঙ্গাইলের আকাশে ফুলের সৌরভে বাতাস হয়েছে সুগন্ধি। এই সুগন্ধির ঢেউ ছড়িয়ে পরবে বিশ্বময়। বাংলা কবিতার ঢেউ আছড়ে পড়ুক পৃথিবীর প্রতিটি কোণায়। জয়তু বাংলা কবিতা।
তৌফিক জহুর
কবি, লেখক
ও
সম্পাদক, উদ্যান