রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানার পশ্চিম আগারগাঁও এর নির্মানাধীন একটি ১০ তলা ভবনের কেয়ারটেকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন মোঃ আনোয়ার হোসেন (৫৫)। জমির মালিকের দীর্ঘদিনের পরিচিত, বিশ্বস্ত ব্যক্তি তিনি।
১৩ এপ্রিল, ২০২০ তারিখ, সোমবার। সন্ধ্যায় মোবাইল ফোনে কথা হয় গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করা স্ত্রী, সন্তানদের সাথে। সাংসারিক বিভিন্ন আলাপ শেষে স্ত্রী সংসার খরচের জন্য কিছু টাকা চান। আনোয়ার স্ত্রীকে আশ্বস্ত করেন দ্রুত টাকা পাঠিয়ে দেবেন। সন্তানদের চলমান করোনা পরিস্থিতিতে সাবধানে থাকতে বলেন, অকারণে বাড়ির বাইরে অবস্থান না করতে আবারও মনে করিয়ে দেন। আনোয়ার হয়ত জানতেন না মোবাইল ফোনে বলা এ কথাগুলোই স্ত্রী-সন্তানদের সাথে তার শেষ কথা হতে যাচ্ছে। নামাজ ও রাতের খাবার শেষে তিনি ঘুমোতে যান ভবনের নিচতলায় তার জন্য নির্ধারিত কক্ষে।
এদিকে ২ দিন পার হয়ে গেলেও আনোয়ারের মোবাইল ফোন বন্ধ পেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন আনোয়ারের স্ত্রী। বাড়ির মালিকও আনোয়ারকে ফোনে না পেয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। ১৫ এপ্রিল সকালে একটি ফোন পেয়েই লকড ডাউনের ভেতর পুরান ঢাকা থেকে ছুটে আসেন বাড়ির মালিক। তিনি এসে দেখতে পান ভবনের ৮ম তলার একটি কক্ষে পা বাধা অবস্থায় আনোয়ারের বিকৃত হয়ে যাওয়া লাশ। এলাকাবাসী খবর দেয় শেরেবাংলা নগর থানায়।
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। পাওয়া যায় বেশকিছু তথ্য। পা বাধা মৃতদেহ দেখে ধারণা করা হয় হত্যার পর বেশকিছু সময় অতিবাহিত হওয়ায় এবং গরম আবহাওয়ার কারণে আনোয়ারের দেহ কিছুটা বিকৃত হয়েছে। লাশ ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। এলাকাবাসীর কাছ থেকে জানা যায়, নির্মাণাধীন ভবনে বেশ কয়েকজন নির্মাণ শ্রমিক কাজ করতেন। তবে, ঘটনার পর থেকে তাদের পাওয়া যাচ্ছেনা। শ্রমিকদের একজনের শুধুমাত্র নাম জানা গেলেও বাকি কারোর সম্পর্কে বিস্তারিত কোন তথ্য পাওয়া যায় না।
হত্যার বিষয়টি জানতে পেরে তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার বিপ্লব বিজয় তালুকদার দ্রুত হত্যাকারীদের গ্রেফতারে নির্দেশ দেন। তেজগাঁও জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার মোঃ মাহমুদ খানের নেতৃত্বে শেরেবাংলা নগর থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মুহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ ও উপ-পরিদর্শক আব্দুর রশিদ সরকারের সমন্বয়ে গঠন করা হয় বিশেষ টিম।
করোনা ভাইরাস বিস্তারের মত ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে এ টিম পুলিশি তদন্ত প্রক্রিয়া ও বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ঢাকা মেট্রোপলিটন ও ঢাকা জেলার বিভিন্ন এলাকায় একাধিক অভিযান পরিচালনা করে একে একে গ্রেফতার করে হত্যার সাথে জড়িত ৫ জনকে। তাদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী উদ্ধার করা হয় মৃত আনোয়ারের মোবাইল ফোনের অংশবিশেষ। গ্রেফতারের পর থানায় এনে বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদে উদঘাটিত হয় হত্যার রহস্য।
বেশকিছু দিন থেকেই পশ্চিম আগারগাঁও এর নির্মাণাধীন ভবনে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করে আসছিলো কাওসার, নয়ন, আফাজ, অনন্ত ও আশিকুল। দেশে করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে বন্ধ হয়ে যায় ভবনের নির্মাণকাজ। হাতে কাজ না থাকায় শ্রমিকেরা বাড়ি চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু, পাওনা মজুরি প্রাপ্তি নিয়ে কিছুটা জটিলতা থাকায় তারা একত্রে সিদ্ধান্ত নেয় বাড়ি যাবার সময় ভবনের পানির পাম্প ও বেশ কয়েক কয়েল নতুন বৈদ্যুতিক তার চুরি করে নিয়ে যাবার। কিন্তু, তাদের বিবেচনায় পরিকল্পনা বাস্তবায়ণে বাধা হয়ে দাঁড়ায় কেয়ারটেকার মোঃ আনোয়ার হোসেন।
আনোয়ারকে কিভাবে সরিয়ে দেয়া যায়, এ নিয়ে পরিকল্পনা আটতে থাকে তারা। আর পরিকল্পনা বাস্তবায়ণের অংশ হিসেবে ১৩ এপ্রিল রাত আনুমানিক ১০ টার দিকে ভবনের উপর থেকে নিচে নামে তারা। একজন পাহারা দিতে থাকে মূল গেট। অপর চারজন গল্প করার ছলে ঢুকে পড়ে একা থাকা আনোয়ারের ঘরে। গল্পের এক পর্যায়ে তারা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় আনোয়ারকে। বেধে ফেলে তার হাত, পা ও মুখ। এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ভবনের আট তলায়। নাক ও মুখের বাধন বেশি শক্ত থাকায় নিস্তেজ হয়ে পড়েন তিনি। কিছুক্ষণের ভেতর মারা যান আনোয়ার। মৃতদেহ ৮ তলায় রেখেই শেষ রাতে আনোয়ারের মোবাইল ফোনটি নিয়ে পালিয়ে যায় তারা। ঢাকা ছেড়ে আত্মগোপন করার পরিকল্পনা থাকলেও পুলিশের চৌকষ অভিযানে মামলা দায়েরের ২৪ ঘন্টারও কম সময়ের ভেতর একে একে গ্রেফতার হয় খুনিরা। বিজ্ঞ আদালতে হাজির করা হলে প্রত্যেকেই সংঘটিত হত্যায় স্বেচ্ছায় নিজের দায় স্বীকার করে জবানবন্দী প্রদান করেছে।
সংবাদসূত্র: ডিএমপি নিউজ