বর্তমানে সামাজিক ও রাজনৈতিক অবক্ষয় এতটাই বেড়ে গেছে যে, সম্পত্তি ভোগ দখলে হানাহানি, রাজনৈতিক দখলদারিতে হানাহানি যেন নিত্য দিনের স্বাভাবিক অবস্থা হিসেবে গড়ে উঠেছে। পত্রিকা খুললেই রক্তের হলি খেলার বাস্তব চিত্র ফুটে ওঠে।
তেমনি একটি বাস্তব সামাজিক অবক্ষয় তুলে ধরেছেন অধ্যাপনা, লেখালেখি ও গবেষণায় নিয়োজিত মোঃ মনিরুল ইসলাম। তার ফেসবুক ওয়াল থেকে হুবহু তুলে ধরা হলো….
[প্রথমেই বলি ঘটনাটি বানিয়ে লেখা নয়; বাস্তব]
…. লোকটির নাম মফিজুল ইসলাম। বয়স বড় জোর ৩৫। রাস্তায় ইজিবাইক চালায়, তাই পথচারী সুধীসমাজের ইজি ভার্সনে তার নাম মফিজ। রাস্তাঘাটের মানুষ, তাই নিজেকেও সে মফিজ নামে চেনে। অন্তত অামার সাথে তার পরিচয়ে সে নিজের নাম মফিজ বলেছিল।
অামার যাওয়ার খবর শুনলে সে বাসস্টান্ডে ইজিবাইক নিয়ে বসে থাকতো। গন্তব্য বলা লাগতো না, চেনা গন্তব্যের গেটে নামিয়ে দিয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে দিতো। তার নাকি পয়সা নেওয়া নিষেধ। জোর করে সাধলে লুঙ্গির গোছায় টাকাটা গুঁজে রাখতো।
মফিজ ভাই সুখী মানুষ। বাড়ীতে চঞ্চল-লাজুক, অথচ গোছানো বউ, ক্লাস এইট অার ওয়ানে পড়া দুটি মেয়ের সংসার ইজিবাইকের চাকার সাথে পাল্লা দিয়ে চলছিল। সুখেই ছিল মফিজ ভাই। স্বপ্ন দেখতো মেয়ে দুটো পড়ালেখা করবে, ইংরেজিতে ফটফট করে কথা বলবে, জজ-ব্যারিস্টার হবে।
হঠাৎ মফিজ ভাই মারা গেলো। মারা যাওয়ার থেকে নিরেট সত্য কিছু নেই; তবে ৩৫ বছর বয়সে দুটো বাচ্চা মেয়েকে এতিম অার চঞ্চল-লাজুক বউকে বিধবা করে গেলে হা-হুতাশটা থাকে বৈকি! এলোমেলো, একেবারেই এলোমেলো হয়ে গেল।
মারা গেলো কেন শুনবেন? সামান্য কারণে। মফিজেরা ৫ ভাই। পৈত্রিক সম্পত্তি যা রয়েছে তা সামান্যই বটে।
ওই সম্পত্তিটুকুর ভাগ-বাটোয়ারায় সমস্যা। দাগ টানোরে… কাঠি পোতোরে… এ মাথা না, ও মাথা… ওই জমির কোনা ব্যাঁকা… ওই জমির রাস্তা কই… ইত্যাদি ইত্যাদি। মফিজ এসব কম বোঝে, সুতরাং মফিজের পক্ষ্যে সামনে অাসে তার সেই চঞ্চল-লাজুক বউ। এদেশে জমির ভাগ-বাটোয়ারার সাথে সাথে পারিবারিক সম্পর্কগুলোর ভাগ-বাটোয়ারা হবে এটাই নিয়ম।
কিন্তু সবার সামনে এভাবে সম্পত্তি খুনের অাগে সম্পর্ক খুন হবে ভাবতে পারেনি মফিজ। কথা চালাচালির এক পর্যায়ে মফিজের বড় ভাই মফিজের বউকে থাপ্পড় দিয়ে বসে। মফিজ ঠেকাতেও পারেনি, সহ্যও করতে পারেনি। বাড়ীতে ফিরে মুখে কালশিরে দাগপড়া বউকে সে কোন জবাব দিতে পারেনি, বাচ্চা দুটোর মুখ চাওয়া চাওয়িটাও নিতে পারে নি।
না, মফিজ অাত্মহত্যা করে নি। অন্তত অাত্মহত্যার অপমান থেকে বাঁচতে পেরেছিল মফিজ, কিন্তু অপমানটি হজম করতে পারেনি। কতটুকু স্ট্রেসই বা নেয়া যায়। স্ট্রোক করেছিল মফিজ, তাতেই মরে গিয়ে নিজের স্ত্রী-সন্তানদের কাছে লজ্জা থেকে বেঁচেছিল সে।
ব্যাচ, সাজানো সংসার, স্বপ্ন সব লেপ্টে গেল অপমানে, অভিমানে। অসমাপ্ত ভাগ-বাটোয়ারার জমিতে কবর দেয়া হলো মফিজের। নিরব-নিথর কবর, অথচ গল্পটা কতটাই না লাফালাফির। এখন যতোই ভাগ-বাটোয়ারা হোক মফিজকে সাড়ে তিনহাত থেকে উচ্ছেদ করবে কে?
৬ দিনের মাথায় মফিজের ইজিবাইকটি বিক্রি হয়ে গেল। রেখে যাওয়া দুটো ছাগল, ছয়টি হাঁস, তিনটি মুরগী বিক্রির টাকার সাথে ইজিবাইক বিক্রির টাকা শাড়ির অাঁচলে বেঁধে নিয়ে মফিজের বউ বাপের বাড়িতে পরগাছা হলো। কিই বা করবে? স্বামী নেই, অচল ইজিবাইকে অায় নেই, কবর দেখে দেখে অার কতোক্ষণই বা দুঃখ ভেজে খাওয়া যায়। ভাসুর-দেবর অাছে বটে, কিন্তু তাদের হাত বড় শক্ত! থাপ্পড়ে মুখে কালশিরে পড়ে যায়!
এতিম বাচ্চা দুটো মায়ের পিছু পিছু নানার বাড়ির ঠিকানায়… ‘যুদ্ধ’ বানানটি শেখার অাগেই জীবনযুদ্ধের সৈনিক তারা! তাদের পৃথিবীতে ‘বাবা’ একটি কাল্পনিক বিষয়, ‘অাদর’একটি কাল্পনিক বিষয়। তারা একটি উপেক্ষিত প্রজন্ম।
যে ভাইটি থাপ্পড় মেরেছিল মফিজের বউকে, সেও স্ট্রোক করেছে কাল। হয়তো অনুতাপে-অনুশোচনায়, নয়তো অভিশাপে। হাসপাতালে অপেক্ষা করছে অারেক সাড়ে তিন হাতের দলিল। যে কোনো সময়, অাজ বা কাল।
অাকড়ে রাখা পৈত্রিক সম্পত্তি গুলো পড়ে অাছে ভাগ-বাটোয়ারা না হয়েই। কাঠি পোতা, দাগ মিলানো অার ভালোজমি-মন্দজমির কথা কাটাকাটিতে শুধু সাড়ে তিনহাতের হিসেবটুকু চলছে নিরন্তর।
পৈত্রিক পরম্পরায় চলতে থাকে ভাগ-বাটোয়ারা, কিন্তু কতোটুকু জমি তোমার? অথচ….!!!! অন্তত, মফিজের গোটা পরিবারটি এখন মৃত, একদম মৃত।
মফিজ ভাইকে দেয়ার মতো একফোটা চোখের জল ছাড়া কিছুই নেই অামার। অামি সেই চেনা গন্তব্যে হয়তো অাবার যাবো, ইজিবাইকে চড়বো, হয়তো মফিজ ভাইয়ের সেই ইজিবাইকে, নতুন মালিকের হাতে নতুন রং লাগানো ইজিবাইকে।