মানুষখেকো মানুষ- বইটি মূলত আঠারোটি গল্পের সংকলনে এক গল্পগ্রন্থ। সবকয়টি গল্প হয়তো শিরোনামের তাৎপর্যতা পুরোপুরিভাবে বহন করে না। সমকালীন বাস্তবতায় আমাদের সামাজিক-পারিবারিক পরিমন্ডলের মানব-মানবীর নানান আলেখ্য নিয়েই গল্পগুলো রচিত। বর্তমান সমাজের বিভিন্ন স্তরে অবস্থানরত মানুষদের চিন্তা,ভাবনার জগৎ, মনস্তাত্ত্বিক নানান দ্বন্দ্ব, সামাজিক প্রগাঢ় বাস্তবতার চিত্র অঙ্কিত রয়েছে বিভিন্ন গল্পগুলোতে। এখানকার চরিত্রগুলো কেবল আমাদের দেশের মানচিত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, তাদের বিস্তৃতি ঘটেছে সীমানার বাইরে। যারা পরদেশে থেকেও এদেশের। ‘জীবন যেখানে যেমন’ গল্পে মুনা চরিত্রটি তেমনই। মার্কিন মুলুকে জন্ম নিলেও প্রতি মুহূর্তে টান অনুভব করে এদেশের প্রতি। বাংলার সংস্কৃতিকে সে ধারণ করে রেখেছে তার অবয়বে। এখানে ফুটে উঠেছে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীদের করুণ বাস্তবতার চিত্র। ‘হিল্লা বিয়ে’ গল্পটিতে নারীদের নির্মম পরিহাসের সেই বর্ণনা রয়েছে বিশদ। একজন পুরুষ চাইলেই ইচ্ছেমতন তার অধীনস্ত নারীকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, মন চাইলেই মুখ দিয়ে তিন তালাক শব্দটি উচ্চারণ করে তাকে ছুঁড়ে দিতে পারে চূড়ান্ত নৈরাশ্যে, সমাজ ও নিজ স্বজনদের কাছে অবহেলার পাত্রী করে তুলতে। নারী যেন পুরুষের হাতের খেলার পুতুল। সমাজ ও পারিবারিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করা অদম্য কিছু নারীর উদাহরণ রয়েছে এতে। ‘লেডি বাইকার’ এর তানিশা ও ‘ছোট্ট এ জীবন’ গল্পের আপেল তাদের প্রতিভূ। পারিবারিক প্রতিকূলতা, জীবনসঙ্গীর অসহযোগিতা সত্ত্বেও যারা ছুটে গেছে দুর্দম গতিতে, প্রবল ইচ্ছাশক্তি ও পরিশ্রম মাধ্যমে সাবলম্বীতা অর্জন দ্বারা গড়ে নিয়েছে নিজেদের পরিচয়। পত্রিকার হেডলাইনে প্রায়শই দেখতে পাই মৃত নারীর লাশের সঙ্গে কতিপয় দুপেয়ে মানুষরূপী জন্তু দ্বারা জঘন্য বিকৃতকামী যৌনলালসার বৃত্তান্ত। ‘মৃত রমণী, চায়ের তৃষ্ণা ও ছাতিমের’ ঘ্রাণ গল্পে সেরকম একটি নিদর্শন রয়েছে। সিমরান নামের এক নারী যে সাময়িক আবেগীয় উচ্ছাসে অপরিণামদর্শী হয়ে প্রচলিত বিধান ভেঙে সমাজ, পরিবারের বাঁকা দৃষ্টি, কটূক্তি হজম করেও বেছে নেয় পরকীয়ার পথ। পরিণামে সবই হারায়; নিজের স্বামী, পরিবার, আত্মীয়-স্বজন এমনকি স্নেহবৎসল সন্তানকেও। যে হাত ধরে অমূলক সুখের স্বপ্নে সে বিভোর হয়, সে হাতটিও তাকে ছেড়ে যায়।
আমাদের বর্তমান সময়ের পারিপার্শ্বিক বাস্তবতা ও মানব-মানবীর জীবনের নানান অধ্যায়, আবর্তনই আলোচিত হয়েছে বইটিতে। যেগুলো বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা ও মানুষের জীবনাচারেরই দর্পণ।
আলোচক : তানজিদা ইসরাত জাহান রিতু