কালের পরিক্রমায় ভর করে নানাজনের হাত দিয়ে নানাভাবে লেখা হয়েছে বাঙলা ও বাঙালির ইতিহাস। ইতিহাসে যেমন সত্য আছে তেমনি কোথাও কোথাও আছে মনগড়া বা লেখকদের নিজস্ব মতামতও। পাঠক কোনোটা গ্রহন করেন কোনোটা করেন না। এটিও নির্ভর করে পাঠক সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কতখানি জ্ঞান রাখেন তার উপর। ইতিহাসের নিবিড় ও গবেষণাধর্মী পাঠক না হলে ইতিহাসের সত্য-বানোয়াট, মিল-অমিল ধরতে পারাও সম্ভব হয়ে ওঠে না। অন্যদিকে সাধারণ পাঠক মাত্রই প্রায় সবটাকেই সাদরে গ্রহণ করেন। কারণ সাধারণ পাঠকের সামনে প্রকৃত বিষয়ে যুক্তি খন্ডন ও সূত্রসহ প্রমাণ দিতে না পারলে কেন তিনি বিকল্প কোনো কিছুর উপর বিশ্বাস স্থাপন করবেন? তাও আবার ইতিহাসের চলমান কোনো পাঠকে অস্বীকার করে?
এমন প্রশ্নের উত্তর নিয়ে উত্তরউপনিবেশী তাত্ত্বিক ফয়েজ আলম লিখেছেন ‘বাঙালির ইতিহাস চর্চার পথের কাঁটা’ গ্রন্থটি। অমর একুশে বইমেলা ২০২৪-এ গ্রন্থটি বাজারে এনেছে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ঘাসফুল। গ্রন্থটির নাম শুনে মনে হতে পারে এটি শুধুমাত্র পথের কাঁটাকেই চিহ্নিত করে দায়িত্ব শেষ করেছে। কিন্তু গ্রন্থপাঠে বেরিয়ে আসে ইতিহাসের অনবিষ্কৃত পাঠও। তাহলে গ্রন্থটির নামকরণের ক্ষেত্রে ইতিহাস নির্ভর মৌলিক কোনো নামকরণ না করে তীর্যক একটি নাম কেন বেছে নেওয়া হলো? এ প্রশ্নের উত্তরও পাওয়া যায় একটু অগ্রসর হলে ‘‘আমার এই লেখা ইতিহাস উদ্ধারের কাম না; কেবল ধর্মের ময়লা আবর্জনার চেহারা আর আসল ইতিহাসের চিনাসগুলা দেখায়া দিতে পারব বলে আশা করতেছি।’’
এখানে বলে রাখা ভালো, গ্রন্থের শুরুতে প্রকাশক সতর্কীকরণ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘‘এ বই বাঙালির ‘মায়ের ভাষা’ অর্থাৎ বাংলাদেশের সর্বাঞ্চলীয় কথ্যরীতিতে লেখা, লেখক যেটিকে ‘মান কথ্যবাংলা’ বলে থাকেন।’’
গ্রন্থের পুরোটাজুড়ে লেখক বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, বাঙালি মুসলমানের একটা বড় অংশ নি¤œবর্গের হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত হননি, বেশিরভাগই এসেছেন বৌদ্ধ ধর্ম থেকে। লেখকের ভাষায়, ‘‘আমরা খুব যৌক্তিকভাবে দেখছি ১২০০ খ্রিষ্টাব্দে হিন্দু ধর্মীয়দের হার বড়জোর ২৫-৩০% হওয়ার কথা। বৃটিশ আমলে ১৮৭২-এর আদমশুমারিতে বাংলায় হিন্দু মানুষের হার দাঁড়ায় ৩৭-৩৮%-এ। বাকি প্রায় সবাই মুসলমান। এই সংখ্যাগুরু মুসলমান যদি হিন্দু ধর্মের মানুষদের থাইকা আসতো তাইলে হিন্দুদের সংখ্যা কইমা যাওয়ার কথা, বাড়ে কি কইরা? কমছে বৌদ্ধ, জৈন ও আদিবাসী ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা। এর থেকেও সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় যে, মূলত বৌদ্ধ ও আদিবাসী মানুষদের বেশির ভাগ মুসলমান হইছে। জৈনরা খুব সম্ভবত প্রায় সবাই হিন্দু হইছে। সেইজন্য মুসলমান দ্রুত ও অনেক বাড়ছে, আর তুলনামূলকভাবে কম হইলেও হিন্দুর সংখ্যাও বাড়ছে।’’
আলোচনার শুরুতে লেখকের উদ্ধৃত অংশটিতে আমরা লেখককে দাবি করতে দেখেছি যে, ধর্মের ময়লা আবর্জনা আর ইতিহাসের চিনাসগুলি দেখিয়ে দেওয়ার জন্য তিনি আশা প্রকাশ করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত লেখক এই ঘোষণার উপর কতখানি দাঁড়িয়ে থাকতে পেরেছেন তা জানার জন্য ৬৭ পৃষ্ঠার একটি অংশ হুবহু তুলে ধরা হলো, ‘‘উনিশ শতকের হিন্দুত্বাবাদী চিন্তাভাবনা বা তার প্রতিক্রিয়ায় তৈরি ইসলামী মনোভঙ্গির আছর থাইকা মুক্ত করতে না পারলে বাঙালির সঠিক ও নিরপেক্ষ ইতিহাস কোনদিনই হবে না’’ লেখকের এই বলিষ্ঠ উচ্চারণ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, হিন্দু-মুসলিম কোনো ধর্মকেই বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হয়নি। লেখকের নিরপেক্ষতার জন্য এমন উচ্চারণ পাঠকদের সমর্থন দাবি করে।
কিন্তু বইটি পড়তে গিয়ে অনেক জায়গাতে লেখক তার নিজের কথার উপরই টিকে থাকতে পারেননি বলে মনে হয়েছে। অর্থাৎ ইতিহাসের যুক্তি ও যুক্ত খন্ডনে তিনি যথেষ্ট শক্তিশালী ভূমিকা রাখলেও যাদেরকে বাঙালির ইতিহাস চর্চার পথের কাঁটা হিসেবে তিনি প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন অনেক ক্ষেত্রেই তাদের প্রতি লেখক সংযত থাকতে পারেননি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ২৫ নম্বর পৃষ্ঠার ২২ নম্বর লাইনে লেখক লিখেছেন, ‘‘ শেষ উদ্ধৃতিটাতে বঙ্কিমের উগ্র সাম্প্রদায়িক চরিত্র ন্যাংটা হয়া ধরা পড়ছে।’’ লেখক যদি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে উগ্র সাম্প্রদায়িক হিসেবে প্রমাণ করতেও পারেন, তবুও তাকে উদ্দেশ্য করে এমন ভাষায় উপস্থাপন করাটাকে পাঠক নিরপেক্ষদৃষ্টিতে দেখবেন না বলেই বোধ করি। কাঠগড়ায় দাঁড় করানো বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখাকে লেখা দিয়ে বা তার যুক্তিকে যুক্তি দিয়ে খন্ডন করার সময় অবশ্যই তা যথাযথ সম্মান ও মর্যাদার সাথেই করা প্রয়োজন বোধ করি। অন্যথায় লেখকও প্রশ্নবিদ্ধ হবেন। শুধু ২৫ নম্বর পৃষ্ঠাই নয়, এমন চিত্র বইটির বিভিন্ন পৃষ্ঠায় সচেতন পাঠকের চোখে পড়বে। তারপরও লেখক তার নিজস্ব পথে হাঁটার চেষ্টা করেছেন। গ্রন্থটি পাঠে জানা যায় যে, তিনি ৪টি মূল বিষয় পাঠককে বলতে, বোঝাতে ও প্রমাণ দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। লেখকের সাথে কেউ একমত পোষণ করুক বা না করুক, বাঙলির ইতিহাস বিষয়ে অনুসন্ধিৎসু পাঠক এখানে নতুন অনেক কিছুর দেখা পাবেন