আমি জানি, আমার এই লেখাটি বেশিরভাগ বন্ধুই পড়বেন না। পড়লেও লাইক দেবেন চার -পাঁচজন। কমেন্ট করবেন আঙুল গুনে এক-দুইজন। যারা ফেসবুকে প্রকাশিত আমার কবিতা বিভিন্ন প্রিন্ট মিডিয়াতে অথবা অনলাইন পত্রিকায় ছেপে দেন, তারাও নীরব থাকবেন। এমন কি এখন এটা ছাপাতে অনুরোধ করলেও ছাপাবেন না। কারন সব দেখেও
আমরা এখন গর্তে লুকাতে শিখেছি।
না দেখার ভান করা, বিপদ এড়িয়ে চলা, শুধু নিজেরা সহিসালামত থাকাকে আমরা খুব দারুণভাবে রপ্ত করেছি। সম্পাদকের নিষেধ, চাকরি বাঁচাতে হবে এমন হাজারও বাধ্য বাধকতায় আমরা প্রত্যেকেই এখন জর্জরিত। শুধু তাই নয়, আমার টাইম লাইনে আমার নিজস্ব মতামত প্রকাশ করার অধিকার ও আমার নেই। হয় হত্যা, নয় গালাগাল আর না হয় নাস্তিকতার পোশাক পরিয়ে দেয়া হবে। আসলে আমাদের সমস্যা বহুমুখী। তারমধ্য এটাও একটি। “নানা মতে নানা পথ” কিন্তু এই পথটি আমরাই বন্ধ করে দিয়েছি। আমরা কেউ কারোটা শুনি না, পড়ি না, প্রকাশ করি না এবং কারোটা তাই সহজভাবে নিতেও পারিনা। আমরা প্রতিবন্ধী জাতিতে পরিনত হতে চলেছি। এই প্রতিবন্ধকতায় চুপ ছিলাম প্রতিবাদী লেখা থেকে। কিন্তু কতই বা আর উটপাখির মত বালুতে মুখ লুকিয়ে ঝড় প্রতিহত করবো!?
চলমান বিষয় বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা। প্রতিটি হত্যাই অত্যন্ত হৃদয়বিদারক এবং মর্মস্পর্শী। প্রতিটি হত্যাই করুন এক ইতিহাসের জন্ম দেয়। আমি তার সম্পূর্ণ বিরোধিতা করে এবং ঘৃণা প্রকাশের পাশাপাশি প্রত্যেকের মৃত্যু দন্ড চাইছি। আমি চাইছি, “বিচারহীন সরাসরি মৃত্যুদন্ড।”
কেন বিচারহীন বললাম? কারণ কিছু হত্যাকান্ড দিবালোকের মত সত্য। যেমন রূপা হত্যা, নুসরাত হত্যা। রাজন হত্যা, ছেলেধরা সন্দেহে কিছুদিন আগে যে মাকে পিটিয়ে হত্যা করা হলো, সর্বশেষ আবরার হত্যা, এই সব এবং এরকমই বহু হত্যাকান্ড আছে যেগুলোতে জনগণ ফুঁসে ওঠে, প্রকাশ্যে চাপাতি রামদা যাদের হাতে থাকে তাদের দু-চারটাকে বিনাবিচারে সরাসরি ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তারপর কেন তারা হত্যা করলো আর এর পেছনে গড ফাদার কে বা কারা আছে!এই তদন্ত করুন বাকিগুলোরে নিয়ে। সত্য জানতে সময় লাগবে না।
আর এদেশে যেহেতু ক্রসফায়ার বৈধ, সেহেতু যে সকল হত্যাকান্ডের তাৎক্ষণিক বিচার জনগন কামনা করে, সেই বিচারগুলো হোক ক্রসফায়ারের মত দ্রুত। প্রকাশ্যে ফাঁসি ফাঁসি দেয়া হোক। বেশি না। মাত্র দু-চারবার।
এবার আসি আরও কিছু বেদনার কথায়।
ফেসবুকের পৃষ্ঠা ধুয়ে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে ড. জাফর ইকবাল, সুলতানা কামাল তসলিমা নাসরিনের ফেসবুক স্ট্যাটাস কিংবা মতামত প্রকাশ করে লেখা বা বিবৃতি নিয়ে। যেমন এখন আমি লিখছি। তো সেই সকল মানুষকে যে ভাষায় গালাগালি দাওয়া হয়, এমন ভাষা আমার ছেলে মেয়েরা ব্যবহার করছে দেখলে আমিই তাদেরকে নিজ হাতে খুন করতাম। আল্লাহ মাফ করুন। এমন দিন যেন আমাকে দেখতে না হয়।
আমি শুধু ভাবি, যারা ফেসবুক ব্যবহার করতে জানে, মন্তব্য করার মত লেখাপড়া যারা জানে তারা এতো নোংরা ভাষা কোন মস্তিষ্কে ব্যবহার করে? লিখে?
তারা কি সুস্থ? জাতি কি সুস্থ? জাতির কথা চলে এলো কারণ, তসলিমা জাফর ইকবালের প্রশ্নে আমার মনে হয় এ দেশের সাড়ে নিরানব্বই ভাগ মানুষই তাঁদের বিপক্ষে দাঁড়াবে। অথচ তাঁরাও কিন্তু তাদের মতামতই প্রকাশ করছেন মাত্র। আপনি স্বাধীন মতামতে বিশ্বাসী। কিন্তু আপনি আমার, তসলিমা নাসরিনের এরকম শতাধিক মানুষের স্বাধীন মতামত নিয়ে মাথা হেঁকে বসছেন! এটাও কি আশ্চর্যজনক নয়??
হ্যা, বলতে পারেন তাঁরা উষ্কানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন। ধর্মের বিরুদ্ধে বলছেন। তো আপনি কি জানেন? আপনি আমি ওনাদের ঘুম খাওয়া হাগু মুতু নিয়ে সমালোচনা করে যেটাকে ধর্মীয় মতে গীবত করা বলে, সেই গীবত করে নিজের মরা ভাইয়ের গোস্ত খাচ্ছি? উনাদের পোশাকআশাক, প্রেম পিরিতি ধর্ম নিয়ে, ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আমরা বিচার করার কে?
আমি যদি এ দুনিয়ায় সত্য কথা বলি,কারো কোন ক্ষতি না করি। সৎভাবে চলি, আমার ব্যবহার যদি নম্র হয়, মমত্ববোধ থাকে প্রতিটি প্রাণীর জন্য। সর্বপরি আল্লাহ বা ভগবানকে অর্থাৎ আপন আপন ধর্ম মেনে চলি, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করি, তাহলে তো কারো সমস্যা নেই। বরং বাড়ির পরিবেশ থেকে শুরু করে সব জায়গাতেই শান্তি বজায় থাকবে। মানুষে ভালোবাসবে, শ্রদ্ধা করবে। আর মৃত্যুর পরেও লাভবান হবো। কিন্ত এগুলোর কিছুই যদি না মানি বরং উল্টোটা করি, তাহলে একালেও ঘরে বাইরে সকলের ঘৃণার মানুষ হয়ে থাকবো, পরকালেও তার চরম শাস্তি ভোগ করতেই হবে। সুতরাং ধর্ম মানাটা জরুরি। ধর্ম এবং আইন একটি আরেকটির সাথে অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত। এই ধর্ম এবং আইন দুটোই সামাজিক শৃঙ্খলার কথা বলে। দুটোই মেনে চলা পৃথিবীর জন্যেও জরুরি। পরকালের জন্যেও মঙ্গলের। যারা পরকাল বিশ্বাস করেন না, তারা যদি এই পৃথিবীতে ধর্ম এবং আইন মেনে চলেন, পরকাল না থাকলে তাদের কি কোন ক্ষতি হবে? নাকি একালে কোন ক্ষতি হবে? ক্ষতি নেই।বরং মানলে দুই কালেই উপকার আছে। আর সেটা ইহকালেও। কিন্তু তাই বলে কট্টর হবেন কেন? অন্ধ হবেন কেন?
মানুষকে মেরে ফেলতে হবে কেন? ধর্ম কি এতো হালকা? যে, আমি গীতা পাঠ করলেই নাস্তিক হয়ে গেলাম? ইসলাম আমাকে ছেড়ে চলে গেলো। জ্ঞান অর্জনের জন্য সুদূর চীনে যেতে বলা হয়েছে। আর সেই জ্ঞান কি ইসলাম সহ আরও বিভিন্ন ধর্মীয় জ্ঞান হতে পারে না? আমি পূজা দেখতে গেলাম, দেবীর প্রশংসা করলাম আর তাই আমাকে সামনে পেলে জিহাদি সৈনিকের মত পিটায়া মেরেফেলে বেহেসতের টিকেট কাটবেন?
এখানেও পবিত্র ইসলামের সুশিক্ষা লুকিয়ে আছে। একটু খুঁজে দেখুন। আর শিক্ষাটা হচ্ছে সহিষ্ণুতার শিক্ষা। যেটাকে ঈমান বলে। আপনার ঈমান এতো দুর্বল হবে কেন যে, তসলিমা উষ্কানিমূলক কথা বললো আর আপনি উষ্কে গেলেন? তাহলে ঈমান বলেই বা কি অবশিষ্ট থাকলো আপনার? আর যার ঈমান নেই, সে তো মুসলমানই নয়। খারিজ হয়ে যাবেন!
বহু হিন্দু, খ্রিস্টানকে দেখা গেছে নিজের ধর্ম ত্যাগ করে মুসলিম হয়েছে। মুসলিমও হয়তো খ্রিস্টান বা হিন্দু হয়েছে। কিন্তু তাই বলে এর বিচার আমি বা আপনি করলে আমার আপনার বিচারও দেশের আইন করবে, পরকালও করবে।
আপনারা যারা ড. জাফর ইকবাল স্যার সহ তসলিমাকে গালাগালি করছেন, তাদের কি নেকি হচ্ছে? নাকি গুনাহ হচ্ছে?একটু বুদ্ধি দিয়ে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করেন তো। তারাও তাদের মত মতামত বা স্ট্যাটাসই দিচ্ছে। অথচ আপনার জায়গায় আপনি তা সহজভাবে নিতে পারছেন না! তাহলে আপনিই বা ওই খুনি ছাত্রলীগদের থেকে আলাদা কি করে হলেন?
এভাবেই যখন চাপাতি আর রামদায়ের কোপে কিংবা,পিটিয়ে রাজন,রানু, রূপা,বিশ্বজিৎ, হুমায়ুন আজাদ,রাজীব দীপন,আবরারদের হত্যা করা হয় তখনও কিন্তু স্বজনদের কষ্টটা একই থাকে। আর দেশ হারায় একটি একটি মেধাবী রত্ন। আর ইসলামী মতে আমরা তখন সত্যি সত্যি আপন ভাইয়ের গোস্ত খাই বা খেয়েই চলেছি।
আসলে আমরা সবাই পাছাতে গু নিয়ে চলছি। কিন্তু নিজেরটার গন্ধটা কেউ পাই না। অন্যেরটা দেখে থু থু করি। সমস্যাটা ঠিক এখানেই। আগে নিজের দিকে তাকিয়ে দেখতে হবে, আপনি কতটা অন্যের ব্যাপারে সহনশীল কতটা উদার। আপনি যদি আমার কথা সহ্য করতে না পারেন, তাহলে আপনার কথা কেন আরেকজন সহ্য করবে? তাই সংশোধন সংস্কার আগে নিজেকে করুন। এসব পরচর্চা আর মাথা হাঁকা বন্ধ করে আত্মসমালোচনা করুন। ধর্ম পালনও হবে। হ্যা, ইসলাম চমৎকার একটা ধর্ম। যদি এটাকে সুন্দর এবং সঠিকভাবে বুঝতে শেখেন, মানতে শেখেন। পাশাপাশি সমাজের অরাজকতাও বন্ধ হবে। সকলের শ্রদ্ধা এবং সম্মান পাবেন। আত্মসমালোচনা করতে না শিখলে শুধু শুধু দেশ জাতিকে নিয়ে খিস্তিখেউড় করে লাভ নেই। কারন দেশের জায়গায় দেশ ঠিকই আছে। শুধু আপনার, প্রত্যকটি আপনার কাছ থেকে সন্তানেরা শিখছে গীবত করা। সমালোচনা করা। ছিদ্র খোঁজা। মুক্তমনা মানেই নাস্তিক, তার কল্লা ফেলেদিতে হবে, অশ্রাব্য গালি দিতে হবে,ঘৃণা করতে হবে এই শিক্ষা আপনার কাছ থেকেই পেয়ে আমাদের সন্তানরা হয়ে উঠছে নষ্ট মানুষ, নষ্ট জাতি। ইসলাম ও নষ্ট হচ্ছে আপনাদের হাতে পড়ে, আপনাদের মানসিকতায়।
সুতরাং মুখোশ থেকে আগে আপনাকেই বের হয়ে আসতে হবে। নইলে পরিবর্তন আশা করা শুধু বৃথাই নয়, অন্যায়ও।
১৩.১০.১৯
“(লেখক ও কবি চন্দ্রশিলা ছন্দার ফেসবুক থেকে হুবহু তুলে ধরা হলো)”