⚫
এক সময় মাটির ঘরে বিছানা পেতে একান্নবর্তী পরিবারের সবাই একসাথে থেকেছি, পাশাপাশি ঘুমিয়েছি। তখন ঘুমাবার জায়গার অসঙ্কুলান হয়নি। মাটির ঘরে তখন নিরাপত্তার জন্য তালা ঝুলানো লাগেনি।
এখন আলিশান বাড়ী! অন্তত চার-পাঁচটা রুমের ফ্লাটেও আমাদের একক পরিবারের জায়গা হচ্ছে না। ২ টন এসির হাওয়ায় ঘর ঠান্ডা হচ্ছে না। হাতিলের কমফোর্ট খাটিয়ায় ঘুমও আসছে না। ঘরে দরজায় দরজায় তালা টিপেও এখন আর ঘরকে নিরাপদ রাখা যাচ্ছে না।
⚫
তখন অভাব ছিল খুব। সবাই একসাথে বসে ভাত ভাগ করে খেতাম। ভাত ভাগের সময় মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। তবুও শান্তি ছিল। শান্তি ছিল খুব। অল্প ভাতের সাথে মায়ের মায়াময় চাহনী আমাদের ক্ষুধা ভুলিয়ে দিত।
এখন অভাব নেই। ডায়নিং টেবিলে খাবারের পসরা, কিন্তু ক্ষুধা আর নেই। গ্যাস্টিকের বড়ি গিলে, সেভেন-আপে গলা ভিজিয়ে যা একটু আধটু গিলছি তাতে শান্তি নেই। এখন কেবল গলাপঁচা অশান্তি।
⚫
আগে মাটির দুনিয়ায় মাটির ব্যবহার ছিল। ছিল মেঠোপথ, গাছতলার ছায়া। ছিল মাটির বাড়ি, মাটি- হাড়ি-বদনা-থালা। তখন ভালো মানুষকে ভালো বলার জন্য বলতাম, ‘একেবারে মাটির মানুষ’।
এখন দুনিয়ায় দিনকে দিন মাটি কমে যাচ্ছে। মাটি পুড়ে পুড়ে ইট নয়তো কনক্রিট হয়েছে। এখন পীচপথ, কনক্রিটের ঝনঝনে বাড়ি। কোথাও আর মাটি থাকছে না, থাকছে না সেই মাটির মানুষ।
⚫
আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছিল না। কিন্তু কি চমৎকার যোগাযোগ ছিল। সম্পর্কে ছিল শ্রদ্ধা-ভালোবাসা-স্নেহ। মানুষের জন্য মানুষের হৃদয় কাঁদতো।
এখন যোগাযোগের ছড়াছড়ি। কেবল সম্পর্কে সততা নেই, মমতা নেই। কেবল প্রতারণা, মানুষকে ঠকাবার কত রকমের কৌশল। সহযোগিতার বদলে কত রকমের প্রতিযোগিতা।
⚫
তখনকার দিনে ছিল গুরুজী, পিতাজী, ওস্তাদজী। ছিল বিনয়, শ্রদ্ধায় নুয়ে আসা মাথা।
এখন ইন্টারনেটের হাইস্পিড, থ্রিজি, ফোরজি, ফাইভজি। গুরুজনের দিকে তাচ্ছিল্ল্য, গরম চোখ, কর্কশ গলা।
⚫
তখন জ্যোৎস্নার আলোয় বড়জোর হারিকেনের আলোয় ঘর আলোকিত হত। সুসন্তানের কীর্তি আলোয় প্রজ্জ্বলিত হত ঘর, পাড়া, গ্রাম।
এখন হাজার পাওয়ারের সাদা ইলেকট্রিক বাল্বেও কুলোয় না। টেবিলে বাতি, টয়লেটে বাতি, টেলিভিশনের বাতি, মোবাইলের বাতি, কম্পিউটারের বাতি তবু ঘর নিকশ কালো। সন্তানের কীর্তিকলাপে মানুষের মুখে অন্ধকার, ঘরে অন্ধকার, মহল্লায় অন্ধকার।
⚫
তখন লেখাপড়া ছিল না, কিন্তু মানুষের মনুষ্যত্ব ছিল। তখন নারী অধিকার ছিল না, কিন্তু নারীর নিরাপত্তা ছিল। আধুনিক চিকিৎসা ছিল না, কিন্তু মানুষ মমতায় ছোঁয়া ছিল।
এখন লেখাপড়া অনেক, কিন্তু মানুষের মনুষ্যত্ব নেই। এখন নারীর অধিকার খুব, কিন্তু নারীর নিরাপত্তা নেই। এখন রাস্তার ভাঁজে ভাঁজে আধুনিক হাসপাতাল, কিন্তু গরম কপালে আপনজনের মায়াময় ছোঁয়াটি আর নেই।
⚫
এখন অভাব নেই। পকেটভরা টাকা, ঘরভরা জৌলুস, আভিজাত্য দেখাতে মানুষের কত রকমের বাহানা! কিন্তু মানুষের শান্তিও আর নেই। চোখে ঘুম নেই। হৃদযন্ত্রে হৃদরোগ, উত্তপ্ত মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ। ঐশ্বয্য আছে, অহংবোধ আছে- কেবল হৃদয়ে শীতলতা নেই, সেই আনন্দময় জীবন আর নেই। মাটির মানুষ নেই, মনুষ্যত্ব নেই, মানুষে মানুষে সততা-মমতার সম্পর্ক নেই। এখন কেবল আত্ম-অহমিকা, কেবল অশান্তি।
⚫
যদি বলি আমি আবার অভাব চাই, তপ্ত দুপুরে মাটির বারান্দায় গা এলিয়ে দু’দণ্ড ঘুমোতে চাই, আবার একসাথে ভাত ভাগ করে খেতে চাই, জ্বরের গরম কপালে মমতাময়ী হাতের পরশ চাই, মেঠোপথে ক্লান্ত পথিক একগ্লাস পানি খেয়ে জিরান দিতে চাই… তাহলে কি খুব বেশি চাওয়া হবে?
সত্যি সত্যি আমি এখন অভাব চাই, শান্তি চাই, দু’দণ্ড শান্তি চাই!
লেখকঃ মনিরুল ইসলাম প্রিজম
পরিচালক,খাঁন বাহাদুর আহছানউল্লাহ ইন্সটিটিউট।